অযোধ্যার চেয়ে সত্য

রামচন্দ্র: যা ছিলেন এবং যা হয়েছেন

যদি ইতিহাসের দৃষ্টিতে রামচন্দ্রকে দেখেন, তা হলে বলতে হবে যে, প্রত্নতত্ত্বের এমন কোনও উপাদান নেই, যা দিয়ে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি স্থানকে রামজন্মভূমি বলে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।

Advertisement

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

ভারতবর্ষে তখন ‘কলোনিয়াল পিরিয়ড’ চলছে। এই সময়ে মনিয়ার উইলিয়ামস সাহেব, যিনি বিখ্যাত স্যান্‌সক্রিট-ইংলিশ ডিকশনারি তৈরি করে ভুবনবিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি ভারতভ্রমণে এসেছিলেন ভারতবর্ষের ধর্ম, নীতি, জীবন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিয়ে। ইংল্যান্ডেশ্বরীর সাম্রাজ্যে ভ্রমণ করতে এসে তিনি দেখতে পেলেন— দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি যেখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেই গ্রামশেষের একটি প্রান্তরে একখানি পাথরের অব্যক্ত মূর্তিকে হনুমানের মূর্তি বলে পুজো চড়ানো হচ্ছে। সেই বৃহৎ প্রস্তরটির মধ্যে নাক-মুখ-চোখের অঙ্গসংস্থানগুলির স্পষ্ট কোনও অভিব্যক্তি নেই, তবু— মনিয়ার উইলিয়ামস দেখলেন— সেই মূর্তিটির উপরে সিঁদুর লেপা হচ্ছে তৈলসহকারে।

Advertisement

সরল ও শ্রদ্ধাশীল সাহেব বলেই তেল-সিঁদুরের ব্যাপারটাকে মানুষের ভক্তিভাবের প্রকাশ বলে মনে করেছেন তিনি। সহজ দৃষ্টিতে এটা ভক্তিভাবই বটে, কিন্তু আমরা সংস্কারসিদ্ধ ভাবে জানি যে, এই তেল-সিঁদুরের মধ্যে ভক্তির সঙ্গে শক্তিসাধনের উপাদান বেশি জড়িয়ে থাকে। কেন না, শক্তির আকর হল রজোগুণ এবং রজোগুণের প্রতীক অবশ্যই লাল। ভক্তি যদি তৈলধারার মতো স্নেহপদার্থ হয়, তবে রক্তবর্ণ সিঁদুরকে সেটি আরও পোক্ত করে ধরে রাখে হনুমানের শরীরে। স্নেহ পদার্থ সেখানে সিঁদুরের ধারণশক্তি হিসেবে কাজ করে। বস্তুত ভক্তি এখানে শক্তিকে ধরে রাখার উপায় ও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রামভক্ত হনুমান যেন এই উপায়ে ভক্ত থেকে বজরংবলী হনুমান হয়ে ওঠেন।

আমরা হনুমানের কথাটা তুললাম এই জন্য যে, ভক্তি এবং ততোধিক শক্তিতে যদি অনভিব্যক্ত প্রস্তরের মধ্যেও ঈশ্বরের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে, তা হলে অযোধ্যার ব্যাপ্ত পুণ্যভূমির মধ্যে একটি বিশেষ স্থানকে যদি ভক্তি-প্রণোদিত বুদ্ধিতে নির্দিষ্ট করে নেওয়ার পর শক্তির প্ররোচনায় বলে ফেলি— এটাই মহামতি রামচন্দ্রের জন্মভূমি, তা হলে আমরা শুধু অসহায় বোধ করতে পারি, কেননা সাধারণ সত্য প্রায়ই অসহায়তার যন্ত্রণায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে।

Advertisement

দেখুন, আমি রামায়ণের রাম নরচন্দ্রমাকে পূর্ণপ্রজ্ঞ স্বয়ং ভগবান বলে মনে করি এবং একই সঙ্গে তাঁকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলেও মনে করি। পুরাণগুলি আমাদের ইতিহাসের দৃষ্টিতে ভাল করে বুঝলে ইক্ষ্বাকুর বংশধারায় তিনি এক সময়ে ধরাধামে বর্তমান ছিলেন, এ কথা মানতে আমার অন্তত অসুবিধে নেই। এবং রামচন্দ্রের মতো অধিগুণসম্পন্ন এক আদর্শ মানুষই যে স্বয়ং ভগবান হয়ে উঠতে পারেন, এ কথা চৈতন্য মহাপ্রভু এবং ভগবান রামকৃষ্ণের দৃষ্টান্তেই প্রমাণিত সত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি এটাই যে, এ দেশে ইংরেজদের কল্যাণে আমরা ইতিহাসের নথি রাখতে শুরু করেছিলাম বলেই রামকৃষ্ণের ছবি, তাঁর জন্মস্থান এবং তাঁর লীলাভূমিগুলির পরিচয় নির্দিষ্ট ভাবে সঠিক পেয়ে যাই। কিন্তু কী বলব, আজ থেকে সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নদিয়ার নবদ্বীপে চৈতন্যের জন্মস্থানই আপনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না। সেখানে পাঁচ হাজার বছর আগের অযোধ্যা নগরীতে কোন নির্দিষ্ট পুণ্যস্থানে রামচন্দ্র জন্মেছিলেন, সে কথা নির্দিষ্ট করে বলাটা আমাদের পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: ১১ প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে বুলবুল, শক্তি খুইয়ে পরিণত গভীর নিম্নচাপে

আজ থেকে পঞ্চাশ/পঞ্চান্ন বছর আগে যাঁরা নবদ্বীপে গিয়েছেন, তাঁরা জানেন— চৈতন্যের জন্মস্থান বলে অন্তত দু’তিনটি জায়গা দেখানো হত। গঙ্গার এ পারেই নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরে, পোড়ামাতলার কাছের গলিতে, আবার ও দিকে মায়াপুরে ঠাকুর ভক্তিবিনোদ এবং ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর বিশ্বাসে চৈতন্যের জন্মস্থান নির্দেশ করা হত। এই নিয়ে নবদ্বীপের গোসাঁইদের সঙ্গে গৌড়ীয় মঠের অধিষ্ঠাতা মহারাজদের চাপান-উতোরও চলত। কিন্তু আমরা জানি, নবদ্বীপের পাশে যে ভাবে ভাগীরথীর ধারা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে চৈতন্যের জন্মস্থান স্থির নির্দিষ্ট থাকার কথা নয়। স্বয়ং রামকৃষ্ণ গঙ্গার মাঝামাঝি জায়গায় সমাধিগ্রস্ত অবস্থায় চৈতন্যের জন্মস্থানের কথা বলেছিলেন। কাজেই সাড়ে পাঁচশো বছর আগেই যেখানে ভগবৎপ্রতিম চৈতন্যের জন্মস্থান নির্ণয় করা যায় না, সেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে কবির মনোভূমিতে অবস্থিত ‘রামের জনমস্থান’ যাঁরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেন, তাঁদের যে ভক্তির চাইতে শক্তি বেশি আছে, সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ থাকে না। সেই ভক্তির প্রতি আমার প্রণাম এবং শক্তির ব্যাপারে ভয়ও রইল।

যদি ইতিহাসের দৃষ্টিতে রামচন্দ্রকে দেখেন, তা হলে বলতে হবে যে, প্রত্নতত্ত্বের এমন কোনও উপাদান নেই, যা দিয়ে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি স্থানকে রামজন্মভূমি বলে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। আর যদি বলেন যে, আরও পরে, অনেক পরে ভক্তের হৃদয় দিয়ে রাম-জন্মভূমি সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং সেখানেই রাম জন্মেছিলেন বলে মেনে নিতে হবে, তা হলে বেশি দিন নয়, ওই সপ্তদশ শতাব্দীতে ঘটিত বৈজ্ঞানিক নিউটনের সেই আপেল গাছটার কথাটাই খুব বড় একটা সমাধান তৈরি করতে পারে। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে, যেখানে নিউটন তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবন কাটিয়েছিলেন, সেই কলেজের বাইরে একটি আপেল গাছ দেখিয়ে এখনও টুরিস্ট-গাইডরা বলেন— এই সেই আপেল গাছ, যার একটি ফল নিউটনের মাথায় লেগে মাটিতে পড়ার ফলেই মাধ্যাকর্ষণের মতো এক বিরাট আবিষ্কার ঘটে গিয়েছিল।

নিউটনের এই আপেল গাছ নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। ঠিক কোন আপেল গাছের ফল নিউটনের চিন্তাক্লিষ্ট মাথায় পড়েছিল, অথবা তাঁর সামনেই পড়েছিল, সে ব্যাপারে নিউটন কিছু বলেননি। আপেল গাছ থেকে আপেল নীচে পড়ার ঘটনাটা নিউটন ভলতেয়ারকে বলেছিলেন, আর বলেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ এক অনুচর জন কনডুইটকে। কনডুইট নিউটনের মৃত্যু-বৎসরে প্রকাশিত তাঁর জীবনের তথ্য সংবলিত একটি গ্রন্থে বলেন— এই আপেল গাছটা সম্ভবত লিংকনশায়ারে অবস্থিত তাঁর মায়ের বাড়ি উল্‌সথর্প ম্যানরের বাগানের একটি গাছ। ১৮১৬ সালে ওই আপেল গাছের চরম দুর্দশা হলেও ওই গাছের শিকড় থেকে নতুন গাছ তৈরি করা হয় এবং সেই গাছের বংশরক্ষার কাজ চলে এখনও। ট্রিনিটি কলেজের আপেল গাছটা নাকি ওই উল্‌সথর্প ম্যানরের গাছটা থেকেই ‘গ্র্যাফ্‌ট’ করা। কিন্তু গাইডরা এই গাছটাকে দেখিয়েই বলেন— ‘এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি...!’

ঘটনা হল— কনডুইট বললেন, অতএব সেই গাছটাই মাধ্যাকর্ষণের জন্মভূমি হয়ে গেল। তবু তাঁর একটা দলিল আছে, ঘটনাটাও রামচন্দ্রের তুলনায় সে দিনের। কিন্তু যাঁরা বললেন এই বাবরি মসজিদের তলাতেই রামজন্মভূমি ছিল, এটা তো অবশ্যই সেই সব ভক্তের বিশ্বাস, যাঁরা ভাবছেন ওখানে যদি কোনও মন্দির থেকে থাকে, তবে ওটাই রামের ‘জনমস্থান’। তবে এই বিশ্বাস দৃঢ় হওয়ার পিছনে যতখানি রামচন্দ্র আছেন, তার চাইতে অনেক বেশি আছেন বাবর।

আমাদের বক্তব্য হল, রামায়ণ মহাকাব্য যদি কবিকল্পিত এক কাহিনি হয়, তা হলে তো ছোট্ট একটি স্থানের মধ্যে রামের জন্মভূমিকে আবদ্ধই করা যাবে না, সেখানে কবির মনোভূমি অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়ে উঠবে। আর রামচন্দ্র যদি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এক পুরুষ হন, তবে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেকার একটা প্রমাণ থাকা দরকার— প্রত্নতাত্ত্বিক বা সাহিত্যিক। যদি এটা নাও থাকে, তা হলে অন্তত রামায়ণ-মহাভারত-মৌর্য-গুপ্ত-মৌখরিদের কোনও প্রমাণ? তা নইলে এখন যে ভাবে রামজন্মভূমির প্রমাণ আসছে, সেখানে হনুমান যে রকম ভক্তি থেকে শক্তির দেবতায় পরিণত হয়েছেন, তেমনই রামচন্দ্রের ‘নরচন্দ্রমা’ উপাধি লুপ্ত হয়ে পারম্পর্যহীন ভক্তদের শক্তিতে অদ্ভুত এক শাক্ত পরিবারের আরাধ্য পুরুষ হয়ে উঠবেন এবং হয়েও পড়েছেন ইতোমধ্যে। আমরা শুধু দুঃখ পাই ক্রৌঞ্চবিরহী কবির জন্য, দুঃখ পাই তুলসীদাসের জন্য। তাঁরা এই বিশালবুদ্ধি সর্বব্যাপ্ত ভগবৎস্বরূপ রামচন্দ্রের কী চরিত্র তৈরি করেছিলেন, আর এখন সেই সর্বব্যাপ্তির আবদ্ধতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে কল্পিত এক ভূমি-পরিসরের মধ্যে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement