সম্পাদকীয় ১

অহেতুক, অশোভন

ধরা যাইতে পারে, এই অর্থটি রাষ্ট্রপতি বা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অভিপ্রেত অর্থ নহে। কিন্তু ভুল বুঝিবার সুযোগটি তাঁহারা করিয়া দিলেন, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৮ ০০:৪২
Share:

ভারতের রাষ্ট্রপতির সময় দুর্মূল্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু ভারতীয় শিল্পীদের সম্মান অমূল্য। চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ও কলাকুশলীদের পুরস্কার প্রদান করিবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি, ইহা দীর্ঘ দিনের প্রথা। রাষ্ট্রপতি কেন সেই রীতি ভাঙিলেন, স্পষ্ট নহে। রীতি যে ভাঙিবেন, তাহা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে কেন জানানো হয় নাই, তাহা দ্বিগুণ অস্পষ্ট। বিশেষত রাষ্ট্রপতির দফতরের সহিত পরামর্শ করিয়াই যখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করিয়াছে, তখন এমন বিভ্রান্তি কেন? যে উত্তরটি মিলিয়াছে, তাহা রহস্যময় বলিলে কম বলা হয়। রাষ্ট্রপতি নাকি জানাইয়াছেন, তিনি পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টার অধিক থাকিবেন না। এই সিদ্ধান্ত হয়তো অমূলক নহে। বহু অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি একান্তই আলঙ্কারিক। কেবলমাত্র নিয়মরক্ষা করিবার জন্য অকারণ কালক্ষেপ করিতে তাঁহার রুচি না-ই থাকিতে পারে, কিন্তু সকল অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সমান নহে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান সকল দেশবাসীর নিকট অতি-প্রতীক্ষিত একটি অনুষ্ঠান। সর্বোপরি, রাষ্ট্রপতি স্বয়ং পুরস্কার প্রদান করিবেন, সকল শিল্পীর নিকট এই অঙ্গীকার করিয়াছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। শেষ মুহূর্তে ‘অপর কাজে ব্যস্ততা’ দর্শাইবার যুক্তি কী? ভুলিলে চলিবে না, জাতীয় পুরস্কারে প্রদত্ত ফলক কিংবা অর্থমূল্য প্রতীকমাত্র। রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই শিল্পীর প্রধান অর্জন। রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি সেই স্বীকৃতি ও সম্মাননার দ্যোতক। তাই ‘সকলের জন্য সময় নাই’ কথাটির অর্থ মনে হইতে পারে, ‘সকলে সমান সম্মানযোগ্য নহে’।

Advertisement

ধরা যাইতে পারে, এই অর্থটি রাষ্ট্রপতি বা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অভিপ্রেত অর্থ নহে। কিন্তু ভুল বুঝিবার সুযোগটি তাঁহারা করিয়া দিলেন, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। স্বভাবতই শিল্পীরা আহত হইয়াছেন। এই প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কারে যেন একটি শ্রেণিভেদ করা হইল। রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এগারোটি পুরস্কার দিবেন, বাকিগুলি দিবেন মন্ত্রী— কাহার উর্বর মস্তিষ্ক এই ব্যবস্থাটি প্রসব করিয়াছে জানা নাই। কিন্তু তাহার ফলে মনে হইতেই বাধ্য যে, শিল্পীদের গুরুত্বে ইতরবিশেষ করিতেছে রাষ্ট্র। যাহা বস্তুত সম্মানিত করিবার অছিলায় অসম্মান করিবার নামান্তর। শিল্পীরা ক্ষুব্ধ বোধ করিলে তাঁহাদের দোষ দেওয়া চলে না। বিশেষত তাঁহারা যুক্তি দিয়াছেন, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি সরকারের প্রতিনিধি, তাই তাঁহার নিকট রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণ যথাযথ নহে। যদি তর্ক করা যাইত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছেন তিনিও দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে, কী ভালই না হইত। কিন্তু অন্তঃসারহীন তত্ত্ব কপচাইয়া লাভ নাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সতীর্থরা সঙ্কীর্ণ রাজনীতিকে উপেক্ষা করিবার উদারতা কখনও দেখান নাই।

সরকারের এই অনমনীয়, অনুদার মনোভাব নাগরিক সমাজের নিকট ঔদ্ধত্য ও অসৌজন্য বলিয়া প্রতিভাত হইতেছে। ইতিপূর্বে যুক্তিবাদী, হিন্দুত্ববিরোধী লেখকদের হত্যা, দলিত হত্যা, প্রভৃতির প্রেক্ষিতে মোদী সরকারের নীরবতায় ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন শিল্পী ও সাহিত্যিকরা। অনেকেই রাষ্ট্রপ্রদত্ত বিশিষ্ট সম্মান ত্যাগ করিয়া তাহার প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন। তাহাতে শিল্পীদের সম্মান খর্ব হয় নাই, সাহিত্য অকাদেমি-সহ রাষ্ট্রপ্রদত্ত পুরস্কারগুলির গুরুত্ব লাঘব হইয়াছে। এ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে, আপাত-তুচ্ছ কারণে ফের তাহাই হইল। পুরস্কার গ্রহণের পূর্বেই বর্জনের অঙ্ক অভিনীত হইল। ইহাতে শিল্পী বা সরকার, কাহারও সম্মান বৃদ্ধি হইল না। আরও আক্ষেপ, রাষ্ট্রীয় সম্মানের মর্যাদা আহত হইল। তাহার মূল্য পুনরুদ্ধারে কত সময় লাগিবে, কে বলিতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement