যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
যুদ্ধজয় হইল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি মত পরিবর্তন করিয়া জানাইয়াছে, কেবলমাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরের ভিত্তিতে নহে, কলা বিভাগের যে বিষয়গুলিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু ছিল, এই বৎসরও সেখানে পরীক্ষা হইবে। যুদ্ধজয়, কারণ লড়াইটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের অধিকারের উপর রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের প্রবণতার। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অপছন্দ, কাজেই প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকিবে না— এই যুক্তিকে, বস্তুত যুক্তিহীনতাকে, প্রতিহত করিবার লড়াইটি সামান্য ছিল না। যাদবপুরের শিক্ষক-ছাত্ররা, এবং রাজ্যের বৃহত্তর বিদ্বৎসমাজ জয়ী হইয়াছেন। অন্তত এই বৎসর যাদবপুরের বিভিন্ন বিভাগ নিজেদের স্বাধিকার বজায় রাখিতে পারিল। এক্ষণে একটি ভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। কর্মসমিতির সদস্যদের একাংশের মত পরিবর্তনের পিছনে কারণ কী, তাহা লইয়া বিভিন্ন জল্পনা থাকিতে পারে, কিন্তু ছাত্ররা ইহাকে যুদ্ধজয় হিসাবেই দেখিবেন। অনশনের অস্ত্রে জেতা যুদ্ধ। প্রশ্ন হইল, এই লড়াইয়ে অনশন নামক অস্ত্রটি কি আদৌ ব্যবহার্য? অনশনের খাঁড়া ঝুলাইয়া, কার্যত ব্ল্যাকমেল করিয়া, কর্মসমিতিকে মত পাল্টাইতে বাধ্য করা— অন্তত ছাত্ররা ভাবিতেছেন যে কর্মসমিতি বাধ্যই হইল— তাহা কি গণতন্ত্রের ধর্ম হইতে পারে? আলোচনার জন্য যে উন্মুক্ত পরিসরটি প্রয়োজন, অনশন কি তাহার পথ গোড়াতেই বন্ধ করিয়া দেয় না? ছাত্ররা আপত্তি করিয়া বলিতে পারেন, যে কর্তৃপক্ষ সরকারের চাপের নিকট নতিস্বীকার করিতেই বসিয়া আছেন, তাঁহার সহিত কি গণতান্ত্রিক আলোচনা সম্ভব? উত্তরটি স্পষ্ট: প্রতিপক্ষ যত বেশি যুক্তিবিবর্জিত, তাহাকে গণতন্ত্রের পরিসরে আসিতে বাধ্য করা ততই জরুরি। তাহাই প্রকৃত রাজনীতি।
উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি, প্রবেশিকা পরীক্ষার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা, সেই পরীক্ষাটি বিভাগীয় শিক্ষকদের হাতেই রাখা বা বাহিরের কোনও সংস্থার হাতে ছাড়িয়া দেওয়া, অথবা বোর্ডের নম্বর ও প্রবেশিকার ফলের কোনও একটি অনুপাতকে মাপকাঠি হিসাবে বাছিয়া লওয়া— প্রতিটিই স্নাতক স্তরে ছাত্র বাছাইয়ের পন্থা। প্রতিটিরই কিছু ইতিবাচক দিক আছে, কিছু নেতিবাচক। যাদবপুরে কোন পন্থাটি মান্য হইবে, সে বিষয়ে তর্ক থাকিতেই পারে। সরকারের মত যেমন চাপাইয়া দেওয়ার প্রশ্ন নাই, তেমনই তাহা সরকারি মত বলিয়াই সম্পূর্ণ উড়াইয়া দিতে হইবে, এই অবস্থানও অযৌক্তিক। ঘটনাচক্রে, যাদবপুরে যখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হইতেছিল, কয়েক কিলোমিটার দূরে এক সভামঞ্চে অমর্ত্য সেনরা গণতন্ত্রে আলোচনার গুরুত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছিলেন। যাদবপুরে এক পক্ষ জিতিল, অন্য পক্ষ হারিল, কিন্তু গণতান্তিক অভ্যাসের মান বাড়িল না।
দোষ শুধু ছাত্রদের নহে। মূল দোষ সরকারের। ২০১৮ সালেই যাদবপুর হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রথাটি তুলিয়া দিতে না পারিলে নবান্ন যদি রসাতলে যাইত, তবে সেই আলোচনার প্রক্রিয়াটি ঢের পূর্বে শুরু করা বিধেয় ছিল। পার্থবাবু সম্ভবত আলোচনা চাহেন নাই— গণতন্ত্রে তাঁহার রুচি নাই— তিনি নিজের মত চাপাইতে ব্যাকুল ছিলেন। যাদবপুরের ছাত্ররা সেই দখলদারি ঠেকাইয়াছেন, কিন্তু গণতন্ত্রের পথে নহে। তাঁহারাও আলোচনার পরিসর তৈরি করিতে পারেন নাই। সরকারকে, উপাচার্যকে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করিবার, ও বিপরীত পক্ষের মত খণ্ডন করিবার প্রক্রিয়ায় টানিয়া আনিতে পারেন নাই। ভর্তি বিষয়ক সিদ্ধান্তে বর্তমান ছাত্রদের মতামত কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেই কথাটি জনপরিসরে প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা করেন নাই। তাঁহারা অনশনের সহজ পথ বাছিয়াছেন। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররাও সে পথে হাঁটিতেছেন। অ-গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ল়ড়াইটি যে এই পথে জিতিতে হইল, তাহাতে জয়ের মহিমা খণ্ডিত হয় বইকি।