রাষ্ট্রহীনতা শব্দটাই এমন যে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের, যে কোনও জনজাতির জীবনে তা এক অজানা আতঙ্কের চোরাস্রোত সৃষ্টি করে। রাজ্য হিসেবে অসম জাতীয় স্তরে ‘মেনল্যান্ড ইন্ডিয়া’র এক প্রান্তিক অবস্থানের নাম, তবু, ২০১৫-১৬ সালের পর থেকে এ রাজ্যের নাম বেশ কয়েক বার উচ্চারিত হয়েছে ভারতময়। মূলত তিনটে বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে এই উচ্চারণ। প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬, নাগরিকত্ব আইনের নয়া ধারা সংযোজন সহ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স (এনআরসি)-এর দুটো খসড়া প্রকাশ এবং শেষ খসড়া প্রকাশের পর এক বিশাল সংখ্যক মানুষের রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়ার ভয়। ৪০ লক্ষ ও আরও ২৯ লক্ষ মানুষের আতঙ্ক এবং সেই আতঙ্ককে হাতিয়ার করে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় আধিপত্য ও বিকৃত প্রতিরোধের রাজনীতিও।
এই সমস্যার নাড়ি খুঁজতে গেলে দেখা যায় যে, বর্তমান অসমের ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকায় আসলে একসঙ্গে চলছে তিন ধরনের লড়াই। প্রথম, উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে শক্ত জমিতে বহাল রাখার চেষ্টা। দ্বিতীয়, হিন্দুত্বের রাজনীতি, যার মধ্যে অবশ্যই জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নও ভীষণ ভাবে জড়িত। এবং তৃতীয়, এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হালে পানি পাওয়ার প্রচেষ্টা। অসমে পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন এবং আগামী বছরেই লোকসভা নির্বাচন। এই সব সঙ্কট ও সম্ভাবনার ফলে আসলে যা হচ্ছে তা হল, বিভিন্ন রকমের ভিন্নতা প্রকট করে, স্পষ্ট দুটো লাইনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার নিরিখে, এক ধরনের অদ্ভুত সামাজিক মেরুকরণ ও আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। এর মধ্যে যোগ হয়েছে নতুন দুটো ঘটনার। পয়লা নভেম্বর বিনা কারণে বা প্ররোচনায় অসমের তিনসুকিয়া জেলার খেরানিবাড়ি গ্রামে পাঁচ জন নিরপরাধ হিন্দু বাঙালির খুন, এবং বোমা বিস্ফোরণে গোঁসাইগাওতে সাদেক আলি নামে এক মুসলমান বাঙালির মৃত্যু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুটো ঘটনার মধ্যে কি সত্যি কোনও যোগ আছে? না কি, দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র টেনে অযথাই আতঙ্কে ভুগছেন অসমের বাঙালিরা?
অসমে এই দ্রুত বেড়ে চলা আতঙ্ক বা অবিশ্বাসের কারণ কী? কেনই বা অসমের বাঙালিরা যে কোনও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেই এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করছেন? কেন তাঁরা ভাবছেন যে এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়ই, বরং অনেকগুলো ঘটনার পারস্পরিক পরিণাম? অনেকের মতে, এই ধরনের ঘটনার দ্বারা আসলে বাঙালি সহ অন্যান্য অ-অসমিয়াদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আর একটু পিছিয়ে যেতে হবে। সমস্যার সূত্রপাত আসলে ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তির পর থেকে। কারণ, এই চুক্তির পর ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬-এ ধারা যুক্ত হয়। এই নতুন ধারাটিতে প্রথম বার স্পষ্ট করে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ম্যাপে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের পরে যাঁরা অসমে এসেছেন, তাঁদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে হবে। যদিও তার অনেক আগে, ১৯৬০ সাল থেকেই বাঙালিরা বার বার রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিবাদ করেছেন কখনও নিজেদের ভাষা রক্ষা বা নিজের ভাষায় পড়াশোনার দাবিতে (১৯৬০ ও ১৯৭২ সালের আন্দোলন), আবার কখনও তাঁদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব রক্ষার কারণে (১৯৭৯-৮০’র বঙ্গাল খেদা আন্দোলন)। কিন্তু, ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তিতে নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষের প্রশ্নে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে, সেই সময় থেকে শুরু হয় বাংলাভাষীদের অসমে একটানা অনিশ্চয়তার ইতিহাস। ২০১৫ সালে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবায়নের কাজ শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে, এবং তার সঙ্গে আবার যোগ হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ের মধ্যে অসমে বহু ঘোষিত বিদেশি ও সন্দেহভাজন ভিনদেশিকে রাখা হয় উদ্বাস্তু শিবিরে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে, যাঁরা সবাই প্রায় বাঙালি। মুশকিল হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ, গরিব ও অশিক্ষিত। যে কারণে রাষ্ট্রব্যাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস, সঙ্গতি ও সাধ্য, কোনওটাই তাদের নেই। এ হেন অবস্থায় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উঠে এসেছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির শর্তগুলোর মাধ্যমে বাঙালিদের আরও কোণঠাসা করার প্রচেষ্টা। এই নাম তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের/প্রমাণপত্রের লিস্টও পরিবর্তিত হয়েছে বেশ কয়েক বার, যার ফলে, অসম থেকে তাঁদের অপসারণের আশঙ্কা ক্রমশই বেড়েছে।
কিন্তু, বাঙালি সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক গণ-সংগঠনগুলো যে হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে, তা নয়। এ বারেও এই ধরনের রাষ্ট্রীয় জুলুমের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, নিজেদের মতো করে নাগরিকত্বের দাবি ও বাকি সব ধরনের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সওয়াল করেছেন। ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকা মানুষদের ওপর অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। সেই মামলায় ৩১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট অসম সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে এবং তার ঠিক পরের দিন, ১ নভেম্বর, এনআরসি-র জন্য আগের ১৫ নথিকে প্রামাণ্য হিসেবে বজায় রাখার রায় দেয়। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক কারণে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অসমের নিপীড়িত এনআরসি ভিত্তিবর্ষ আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রতিশ্রুতি দেন কোচবিহারের এক জনসভায়। গুয়াহাটিতে গায়ক শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের অপমানিত হওয়ার খবরও সর্বভারতীয় মিডিয়ায় উঠে আসে। এই সব কারণে অসমের বাঙালিরা যখন সবে একটু আশার আলো দেখতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই নিরপরাধ ছয় জন বাঙালির মৃত্যু তাদের আবার এক অদ্ভুত দোলাচলে ঠেলে দিল। প্রথমে এই হত্যার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হল আলফা (ইন্ডিপেন্ডেন্ট) জঙ্গিদের ঘাড়ে, কিন্তু ২ নভেম্বর তারা প্রেস বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট জানাল যে, এই ঘটনার সঙ্গে তাদের সংগঠনের কোনও যোগ নেই। তা হলে, তিনসুকিয়ার ধলা-সদিয়া সেতুর কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, সামরিক পোশাকে যারা নির্বিচারে গুলি করল, তারা কারা? কেন অসহায় মানুষগুলোকে তারা নিশানা করেছিল সেই রাতে? সত্যি কি এনআরসি-র সঙ্গে এর যোগ আছে?
অসমের, বিশেষ করে কাছাড়ের বাঙালিরা ভাবছেন, এই হামলা চালানো হয়েছে রাজ্য জুড়ে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য, যাতে তার থেকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থসাধন করতে পারে। তাঁদের মতে, এনআরসি-র কারণে কোণঠাসা সরকার চাইছে না, বাঙালিরা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরুন। বাস্তবিক, এই হামলার পর আতঙ্কের মাত্রা এতটাই ছড়িয়েছে যে, অধিকাংশ মানুষ নড়েচড়ে বসেছেন, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে অসহায় বোধ করে অনিশ্চয়তার আবহে কোনও একটি বিশেষ পক্ষে যোগ দেওয়াকে তাঁরা সুবিধেজনক/প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন।
অসমের জেলাগুলোতে কত বড় বড় সমস্যা আছে: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক, পানীয় জল —এবং দারিদ্র। সেগুলোকে বিন্দুমাত্র অামল না দিয়ে বিরাট পরিমাণ টাকা খরচ করা হচ্ছে ‘কাগজ’ খোঁজা বা সংগ্রহ করার খাতে। তাতে রাজ্যের উন্নতি তো ধাক্কা খাচ্ছেই, অন্য দিকে সাধারণ মানুষরা আরও গরিব হচ্ছে। ‘ঘুসপেটিয়া’ হিসেবে প্রমাণিত না হওয়ার জন্য, শুধু এনআরসি-র কারণে অাত্মঘাতী বাঙালির সংখ্যা এখন অবধি ১৭। কয়েক লাখ মানুষের অস্তিত্বকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র কাগজের ওপর। ‘মিয়াঁ’ অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা এখন কেমন, কল্পনা করাই যায়। অসমে যে শক্তিটি নিপীড়িত মানুষের মানবিক অধিকার মানতে চাইছে না, নাগরিকত্বের ‘সঙ্কট’ সৃষ্টি করে, কাগুজে পরিচয়কে একমাত্র প্রমাণ সাব্যস্ত করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আইনি অলিগলি ঘোরাতে লেগেছে, তারা রাজ্যের অধিবাসীদের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। এ সব দেখতে দেখতে গোটা দেশের মানুষ আশঙ্কিত হচ্ছেন, আশির দশকের অসম আবার ফিরে আসছে না তো?
ডায়মণ্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক