বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতিপালন করিতে সন্তান যদি রাজি না হয়, তবে কে দেখিবে? উপার্জনে অক্ষম প্রতিবন্ধী সহোদরেরই বা কী হইবে? অসম সরকার ইহার প্রতিকার করিতে আইন পাশ করিয়াছে। তাহার বিধান, সরকারি কর্মীর পিতামাতা অবহেলার অভিযোগ করিলে বেতনের এক দশমাংশ কাটিয়া পিতামাতার অ্যাকাউন্টে সরাসরি পাঠাইবে সরকার। প্রতিবন্ধী ভাইবোন থাকিলে আরও পাঁচ শতাংশ কাটা হইবে। এই বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ ও বিচারের জন্য তিন সদস্যের এক কমিশন গঠন করিয়াছে অসম সরকার। ইহার পর বেসরকারি কর্মীদেরও এই আইনের অধীনে আনিবার পরিকল্পনা আছে। এই সিদ্ধান্ত লইয়া বিবিধ প্রশ্ন উঠিতে পারে। পরিবারের কে কাহার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে, কতটা করিবে, তাহা কি সরকার নির্দিষ্ট করিতে পারে? পিতামাতাকে অবহেলার অভিযোগ সত্য কি না, প্রতিপালনের দায়িত্ব সকল সন্তানের মধ্যে যথাযথ বণ্টিত হইল কি না, তাহাই বা নির্ধারিত হইবে কী রূপে? প্রশ্নগুলি অস্বস্তিকর। ২০০৭ সালে কেন্দ্র পিতা-মাতা ও বয়স্ক নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আইন করিয়াছিল। সেই আইনও কার্যত উপেক্ষিত রহিয়াছে। সন্তানের জরিমানা বা কারাবাসের শাস্তির সম্ভাবনার তুলনায় মাসে মাসে টাকা পাইবার সম্ভাবনা হয়তো পিতামাতার জীবনে কিছুটা নিশ্চয়তা আনিতে পারে। ভারতে দশ কোটিরও অধিক বৃদ্ধবৃদ্ধার অতি অল্পই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পান। সন্তানের মুখাপেক্ষী হইয়াই তাঁহারা বাঁচিয়া আছেন।
কিন্তু সন্তান কি দায় লইতে আগ্রহী? বাংলার বিধবাদের বারাণসী কিংবা বৃন্দাবন পাঠাইবার রীতি অনেক দিনের। অচেনা অঞ্চলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ছাড়িয়া আসে অনেকে। বাঁশবনে পড়িয়া ইন্দির ঠাকরুনের দীন মৃত্যু যখন ঘটিয়াছিল, তখনও বঙ্গে গ্রামের সামাজিক সম্পর্কগুলি ছিঁড়িয়া যায় নাই। আজ পরিবার-প্রতিবেশিতার বন্ধন শিথিল হইয়াছে। কাজের সন্ধানে গ্রাম হইতে শহরে, ভিনরাজ্যে কিংবা ভিনদেশে পাড়ি জমাইতেছে সন্তান। পিতামাতার নিঃসঙ্গতার সহিত যুক্ত হইতেছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। যাঁহারা কর্মজীবনে সচ্ছল ছিলেন, বার্ধক্যে তাঁহারাও দারিদ্রে পতিত হইতেছেন। সঞ্চয়হীন শ্রমিক পরিণত হইতেছেন ভিখারিতে। উন্নত স্বাস্থ্য এবং বর্ধিত আয়ু সকলের জীবনে আশীর্বাদ হইয়া আসে নাই।
সম্পন্ন দেশে সরকারি ব্যবস্থায় বৃদ্ধদের ন্যূনতম সুরক্ষা দান করা হয়। অসম সরকারের প্রকল্পটি রাজ্যের চার লক্ষ সরকারি কর্মীর আট লক্ষ পিতামাতার কাজে লাগিতে পারে। বাকিদের কী হইবে? ভারতে দশ জন কর্মীর নয় জনই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। সেখানে ভবিষ্যনিধি কিংবা পেনশন, কিছুই নাই। সঞ্চয়ের সুযোগ সামান্য। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা বা সরকারি বৃদ্ধাশ্রম অপ্রতুল। তদ্ব্যতীত, কেবল অ্যাকাউন্টে অর্থ প্রেরণ যথেষ্ট নহে। বৃদ্ধদের দৈনন্দিন সহায়তার প্রয়োজন রহিয়াছে। অতএব গ্রামের সমাজকে বৃদ্ধদের রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত করিতে হইবে। তামিলনাড়ুতে স্কুলের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে পরিজনহীন বৃদ্ধদেরও আহ্বান করা হয়। সেই দৃষ্টান্তে অঙ্গনওয়াড়ির সহিত বৃদ্ধদের যুক্ত করা, কিংবা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দ্বারা বৃদ্ধদের সহায়তার প্রকল্পও করা সম্ভব। তাহার প্রয়োজনীয় অর্থ স্থানীয় সরকার, অথবা কেন্দ্র ও রাজ্য মিটাইবে। গ্রামে কর্মসংস্থান হইবে, বৃদ্ধদের সুরক্ষাও মিলিবে।