অসহযোগ আন্দোলন যে পরোক্ষে এ দেশে আরও বড় এক সঙ্কটের পথ খুলে দিতে পারে, সে বিপদ সম্বন্ধে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আন্দোলনকারীদের কাণ্ডকারখানায় ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রহ্মচর্য-আশ্রমের উদ্দেশে এক চিঠিতে (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) লিখলেন, “Nationalism হচ্ছে একটা ভৌগোলিক অপদেবতা, পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত; সেই ভূত ঝাড়ার দিন এসেছে।” এ তো দেশের নাম করে বাধা দেওয়ার বেড়া তুলে, আদতে দেবতার প্রবেশপথে বাধা! সেই চিঠিতেই দুই বিদেশি বন্ধু-সহকর্মীর কথা ভেবে তাঁর উদ্বেগের কথাও লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। যে হারে আমরা ‘নিজের ঘরকে নিজের কারাগার’ করে তোলার মন্ত্রে মত্ত হচ্ছি, তাতে হয়তো এমন দিন আসবে, যে দিন অ্যান্ড্রুজ়, পিয়ার্সনকেও ত্যাগ করার দাবি উঠবে। তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ মনে করালেন, কী ভাবে এর আগে একই দোহাই দিয়ে কিছু ‘হিন্দু ছাত্র’ পিয়ার্সনকে একটি বক্তৃতায় আহ্বান করতে অসম্মত হয়।
রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিরোধিতায় প্রতিবাদপত্র দিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী। সেই চিঠিতে (প্রবাসী, আষাঢ় ১৩২৮) রবীন্দ্রনাথের প্রতি যথাসম্ভব সম্মান বজায় রেখেও তিনি লিখলেন, রবীন্দ্রনাথ দূরে থেকে দেশের প্রত্যক্ষ কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, মিথ্যা সংবাদে তিনি প্রভাবিত হচ্ছেন (‘ইউ আর ফেক নিউজ’?)। এই আন্দোলনের হাত ধরে প্রকৃতই ‘ভারতের সহিত বিশ্বের যোগ-সাধনের বাধা’ দূর হচ্ছে। এই আন্দোলনে আপত্তি জানানো আদতে ‘অধার্মিকদের (ইংরেজ) অধর্মকাজে সহায়তা’ করা (‘দেশদ্রোহী’?)। কিছু ‘হিন্দু ছাত্র’ পিয়ার্সনের বক্তৃতায় আপত্তি জানানোর প্রসঙ্গে বিধুশেখরবাবু যুক্তি দিলেন, এ আসলে আন্দোলনের দোষ নয়। দোষ নির্দিষ্ট ব্যক্তির (বিচ্ছিন্ন ঘটনা?)।
অসহযোগ আন্দোলনের শতবর্ষে পা দিতে বেশি দেরি নেই। এতটা পথ পেরিয়েও কি আমরা নিজেদের পাল্টাতে পেরেছি? দেশের নামে বজ্জাতির সাম্প্রতিক ইতিহাস অন্তত আমাদের কোনও ভরসা জোগাচ্ছে না। ‘জাতীয়তাবাদ’-এর জামা পরিয়ে কেমন অবলীলায় সীমাহীন এই অরাজকতাকে ‘নর্মাল’ বলে প্রতিষ্ঠা করা গেছে। আর তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়াটাও আজ ফৌজদারি অপরাধ। কয়েক বছর আগে বুঝেছিলেন আমির খান। এখন টের পেলেন নাসিরউদ্দিনও। ধর্মীয় পরিচয়কে যাঁরা কোনও দিনই তাঁদের জীবনে প্রধান করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছেন, এ দেশে সেটিই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। অন্তত বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের চোখে। তাই অমিত মালব্যের অনলাইন ট্রোল আর্মি থেকে সহ-অভিনেতা অনুপম খের— সকলেরই নিশানায় এখন নাসিরউদ্দিন।
নাসিরউদ্দিনের অপরাধ, তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন পুলিশ কর্মীর খুনের চেয়ে একটি গরুর মৃত্যু বেশি গুরুত্ব পাবে? বেপরোয়া ভিড়তন্ত্রের এই বাড়বাড়ন্তে তিনি সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের এই পরিস্থিতি তাঁকে ক্রুদ্ধ করে। কোনও সহ-নাগরিকের উদ্বেগ প্রকাশ করা কবে থেকে অপরাধের তকমা পেল? উদ্বেগের কথা বলে সে দিনও বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সংশয় থাকলেও বিধুশেখরবাবুদের সমালোচনায়, গাল পেড়ে নয়, রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগকে যুক্তি দিয়ে ভ্রান্ত প্রমাণের চেষ্টা ছিল। আর আজ নাসিরদের দেশদ্রোহীর তকমা মিলেছে। থানায়-আদালতে অভিযোগ হচ্ছে। পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নিদান তো রয়েইছে। আজ আর পিয়ার্সনরা নেই। ‘আক্রমণকারী’ নাসিরউদ্দিনেরা রয়েছেন। তাঁদের দেশত্যাগের ঠিকানাও আজ নির্দিষ্ট হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মদতে আজ জাতীয়তাবাদের যে গণহিস্টেরিয়ার প্রশ্রয় মিলেছে, তাতে এক দিন আস্ত দেশটাকেই না পাকিস্তানে নির্বাসনে যেতে হয়।
আজকের এই ভিড়তন্ত্রে প্রশ্রয় রয়েছে বলিউডেরও। চলচ্চিত্রের পর চলচ্চিত্রে এমন ভিড়তন্ত্রকেই তারা ন্যায় আদায়ের জনপ্রিয় পথ বানিয়েছে। কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন, দেশের এত বড় শিল্প ইন্ডাস্ট্রির নির্মাণে আজকাল সময়ের চিহ্ন কোথায়? আছে। রাষ্ট্র আর সরকারের তাঁবেদারির মধ্যে আছে। জহরব্রতের গৌরব ঘোষণায় আছে। গলার শিরা ফুলিয়ে প্রতিবেশী দেশকে গালি দেওয়ার মধ্যে আছে। নাগরিককে জিপের সামনে বেঁধে ঘোরানোর বিতর্কিত দৃশ্যকে অবিকল চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে আছে। বলিউড যেন এ দেশের সংখ্যাগুরুর ‘স্টিরিয়োটাইপ’ মনোভাবকেই ন্যায়সম্মত বলে গৌরাবান্বিত করে। সেখানে সংখ্যালঘু, ভিন্ন মতের ঠাঁই কোথায়? তাই মনের কথা খুলে বলে নাসিরউদ্দিনের মতো ‘প্রিভিলেজড’ ব্যক্তিত্বও হুমকি আর হেনস্থার মুখে পড়ছেন, তা হলে আমজনতার হাল কী হবে? মণিপুরের সাংবাদিক কিশোরচন্দ্রের চেয়ে অধম।
বিধুশেখরবাবুর বিশ্বাস ছিল, “দেওয়াল গাঁথিয়া নিজের ঘরকে ইহা (অসহযোগ আন্দোলন) কারাগার না করিয়া বরং তাহাকে বিশাল প্রাসাদ করিয়ে তুলিতেছে, যাহাতে বিশ্বজন সমবেত হইয়া বিশ্ব-দেবতার উপাসনা করিবে।” আজ বেঁচে থাকলে তিনিও বুঝতেন সেই প্রাসাদ শুরু থেকেই ফুটো। মিথ্যা দিয়ে গড়া। জাতীয়তাবাদ কোনও দিনই তার সমাধান ছিল না। হবেও না।
ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক