মজার কথা বলে হাসাতেও পারতেন জীবনানন্দ

এক অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়ে জীবনানন্দ চায়ে কয়েক বার চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চা-টা যদি আপনার কথা মতো কড়া হত, তা হলেও উপভোগ্য হত।’ লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারবাংলা সাহিত্যের পাঠকেরাও কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিরূপ এ ভাবেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। হয়। কিন্তু এ পরিচয় জীবনানন্দের সত্যিকারের পরিচয় নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০৫
Share:

জীবনানন্দ হাসাতে পারতেন, নিজে হাসতেও পারতেন। এবং যে সে হাসি নয়। একেবারে লোককে চমকে দেবার মত হাসি।

কেউ বলেছেন, তিনি অন্তর্মুখী, আত্মসমাহিত। কেউ বলেছেন, তিনি নির্জনতম। কেউ বলেছেন তিনি সংসার-পলাতক। আবার কেউ গলার পর্দা আরও একটু চড়িয়ে বলেছেন তিনি অমিশুক, অসামাজিক।

Advertisement

বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরাও কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিরূপ এ ভাবেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। হয়। কিন্তু এ পরিচয় জীবনানন্দের সত্যিকারের পরিচয় নয়। যাঁরা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছেন, তাঁরা দেখেছেন, তিনি সহজ, সরল, মিশুক, গল্পপ্রিয়, পরিহাস-পটু এক সামাজিক মানুষ। হাসাতে পারতেন, নিজে হাসতেও পারতেন। এবং যে সে হাসি নয়। একেবারে লোককে চমকে দেবার মত হাসি। পরিচিত মহলে তার হাসি বিখ্যাত ছিল। তাঁর হাসিকে কেউ বলেছেন, ‘উৎকট হাসি’, কেউ বলেছেন ‘অট্টহাসি’, কেউ বলেছেন ‘মেজাজি হাসি’ ইত্যাদি। হাসির সময় জীবনানন্দ স্থান কাল ভুলে যেতেন। এই হাসির মধ্যেই ধরা পড়ত তাঁর সহজ সরল অন্তঃকরণ।

বড়িষা কলেজে এক সহকর্মীর কাছে তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসু, নির্জন কবি নির্জন কবি বলে আমার সম্পর্কে একটা লিজেন্ড খাড়া করেছেন যেটা আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।’ বোন সুচরিতা দাশ ‘কাছের জীবনানন্দ’ তেও লিখেছেন, কবিকে ঘিরে জনশ্রুতি কতটা ভুল। জীবনানন্দের পথচলা ও আড্ডার সঙ্গী সুবোধ রায় লিখেছেন, জীবনানন্দ কতটা আড্ডাপ্রিয় ও পরিহাসপ্রিয় ছিলেন তার কথা। সুবোধ রায়ের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়, কবি গল্প করতে এতটাই ভালবাসতেন যে তাঁর বাড়িতে সন্ধেয় গল্প করতে গেলে অনেকদিনই রাত্রি একটা-দেড়টা হয়ে যেত।

Advertisement

জীবনানন্দের জীবনের (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ থেকে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪) শেষ চাকরি হাওড়া গার্লস কলেজে। এই কলেজেই প্রথম জীবনানন্দ পেয়েছিলেন অধ্যাপনার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। জীবনানন্দকে এই কলেজে ছাত্রী, শিক্ষক সবাই ভালবেসেছিল। তিনিও কলেজকে ভালবেসেছিলেন। পরিবেশ নিজের মনের মত হলে তিনি নিজেকে মেলে ধরতেন। হাওড়া গার্লস কলেজেও তার অন্যথা হয়নি। এই কলেজে জীবনানন্দের সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। অসিতবাবু জীবনানন্দকে বর্ণনা করেছেন ‘হাস্য-পরিহাসের অংশভাগী’ ও ‘বন্ধুবৎসল’ বলে। এই কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী জীবনানন্দকে বলেছেন ‘একজন সঙ্গলোভী সামাজিক মানুষ।’ তিনি লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের যে বিচিত্র মনোরম পরিচয় আমরা পাইয়াছি, স্মৃতির ভাণ্ডারে তাহার মূল্য অপরিমেয়।’

জীবনানন্দ সম্পর্কে গড়ে ওঠা জনশ্রুতি নিয়ে স্ত্রী লাবণ্য দাশ এক বার কবিতা সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উষ্মাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে বাড়িতে যে মানুষটিকে সর্বক্ষণ দেখেছেন, তিনি যে একেবারেই আলাদা। বিয়ের পরে স্ত্রী যাতে ঠিকমত পড়শোনা করতে পারে তার জন্য যত্নশীল, বোন-ভাইয়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে আগ্রহী, নীতির প্রশ্নে আপসে যেতে নারাজ এবং যথেষ্ট ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। এই মানুষটিকে তিনি ওই সব জনশ্রুতির সঙ্গে মেলাবেন কী ভাবে! তাঁর কাছে বাইরের ওই সব কথা অনেকটাই ‘বানিয়ে তোলা’।

বোন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, ‘জীবনানন্দ বাড়িতে এত মজার মজার কথা বলতেন যে সবাই হেসে কুটিপাটি হত। সে সময় দাদাটিকে দেখলে কে বলবে, ইনিই এত গুরুগম্ভীর কবিতা লেখেন!’ মজার মজার কথা বলে অন্যকে হাসানোর স্বভাব জীবনানন্দের ছেলেবেলা থেকেই ছিল। এই স্বভাব সম্ভবত তিনি পেয়েছিলেন মাতুল বংশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। জীবনানন্দের দাদামশাই চন্দ্রনাথ দাশ ছিলেন রসিক মানুষ। তিনি অনেক হাসির গানও লিখেছিলেন। ভাই অশোকানন্দ লিখেছেন, ‘পার্কে, রাস্তায় কোথাও হিউমারের গন্ধ পেলেই জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে যেতেন। তারপর আড়ালে গিয়ে সঙ্গী বন্ধুর কাছে, অথবা বাড়িতে এসে নিকটজনেদের কাছে তা রসিয়ে পরিবেশন করতেন।’

জীবনানন্দের রঙ্গ রসিকতার নানা গল্প তাঁর কাছের মানুষেরা লিখে গিয়েছেন। সত্যি জীবনানন্দের হদিশ পেতে গেলে সেই সব গল্পে একটু কান পাততে হবে। কয়েকটা উদ্ধার করা যাক।

অশোকানন্দ আর তিনি তখন কলকাতার অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি বিএ, আর অশোকানন্দ আইএসসি। এক দিন সকালবেলা বাইরে থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ভাইকে একজন ধনী, নামজাদা অধ্যাপকের নাম করে বললেন, ‘শিগগির আয়। দেখে যা হোস্টেলের সামনে দিয়ে কেমন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন!’ নামজাদা, ধনী অধ্যাপক মশাই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন শুনে অশোকানন্দ একটু অবাকই হলেন। দাদার সঙ্গে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখেন, মলিন শার্ট পরে এক জন ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁর সঙ্গে অধ্যাপক মশাইয়ের চেহারার অনেক সাদৃশ্য।

অশোকানন্দের লেখা থেকে দাদার কৌতুকপ্রিয়তার আর একটি গল্প। সেই সময় তিনি দিল্লিতে অশোকানন্দের কাছে আছেন। ভাইয়ের বাড়িতে অনেক বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সমাগম হয়েছে। এক দিন সকালবেলা অশোকানন্দ নিজের ঘর থেকে দাদাকে শুধোলেন, ‘তোমার বাথরুম খালি আছে কি?’ জীবনানন্দ জবাব দিলেন, ‘দিল্লির মসনদ কি কখনও খালি হয়?’

হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনাকালীন তাঁর রস-রসিকতার অনেক কথা জানা যায়। যেমন, এক দিন এক অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়েছেন সবার সঙ্গে। অধ্যাপক বন্ধুটি ছিলেন স্পষ্টবাদী এবং স্পষ্ট কথাটা বলতেন বেশ কড়া ভাবে। সবার জন্য চা-জলখাবার এল। জীবনানন্দ চায়ে কয়েক বার চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চা-টা যদি আপনার কথার মত কড়া হত, তা হলেও উপভোগ্য হত।’

জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ বন্ধু সুবোধ রায় লিখেছেন, ‘রাস্তায় কোনও মোটা পুরুষ অথবা মহিলা দেখলে তিনি তাদের নিয়ে আড়ালে এসে নির্দোষ মস্করা করতেন। তাঁর আর একটি মস্করার বিষয় ছিল তাঁর মাথায় গজিয়ে ওঠা টাকটা নিয়ে।’

জীবনানন্দের পরিচিত মূর্তির সঙ্গে এ সব মিলবে না। যেমন মিলবে না, সংসারে শান্তি আনার জন্য তাঁর ভাড়াটেকে উৎখাত করার তৎপরতা। আর্থিক দুরবস্থা ঘোচাতে নিজের ফ্ল্যাটের একটা ঘরে এক মাঝবয়সী মহিলাকে ভাড়াটে হিসাবে বসিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই প্রকাশ পেল মহিলার স্বরূপ। মহিলার ঘরে অন্যধরনের লোকের সমাগম হতে লাগল। কবির মানসিক অশান্তি শুরু হল। তিনি উঠেপড়ে লাগলেন মহিলাকে উৎখাত করতে। সাহায্যের জন্য অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিরও শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না। আইনি পথে সুবিধা করতে পারবেন না ভেবে, এক সময় গুন্ডা দিয়েও মহিলাকে উৎখাত করার কথা তিনি ভেবেছিলেন। এরপরেও কি জীবনানন্দকে ‘সংসার-পলাতক’ বলা যাবে? অনেকের মতে বাড়ির এই দুশ্চিন্তাতেই ১৯৫৪ সালের সেই অভিশপ্ত ১৪ অক্টোবর ট্রামলাইন দিয়ে হাঁটার সময় তিনি অমন অন্যমনস্ক ছিলেন।

লেখক ভগবানগোলা হাইস্কুলের শিক্ষক

ঋণ: ‘জীবনানন্দ’/গোপালচন্দ্র রায়, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি’/দেবকুমার বসু (সম্পাদিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement