বারুণী স্নান থেকে গোপীনাথের মেলা

মেলাকে কেন্দ্র করে অগ্রদ্বীপ এবং তার চার পাশের দু’ থেকে তিন কিলোমিটার এলাকা প্রায় মিলনতীর্থের চেহারা নেয়। দশ থেকে ১২ লক্ষ মানুষ আসেন। লিখছেন মহেশ্বরপ্রসাদ লাহিড়িঅনেকে মনে করেন, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনে অগ্রদ্বীপে ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন শ্রীচৈতন্য। এখানে শ্রীচৈতন্যে একটি কৃষ্ণের বিগ্রহ তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নাম দেন গোপীনাথ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০২:০১
Share:

অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

পূর্ব বর্ধমানের ক্ষুদ্র জনপদ অগ্রদ্বীপ। এই অঞ্চলটি গোপীনাথ এবং বৈষ্ণব সাধক গোবিন্দ ঘোষের কারণে খ্যাত। ফি-বছরই চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। এই মেলাটি অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা নামে পরিচিত। এই মেলার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন সাধক গোবিন্দ ঘোষ এবং তাঁর আরাধ্য গোপীনাথ। স্থানীয় বাসিন্দা এবং গোপীনাথের সেবকেরা জানান, এই মেলাকে কেন্দ্র করে অগ্রদ্বীপ এবং তার চার পাশের দু’ থেকে তিন কিলোমিটার এলাকা প্রায় মিলনতীর্থের চেহারা নেয়। ২০১৪ থেকে প্রতি বছর দশ থেকে ১২ লক্ষ মানুষ এই মেলায় আসেন। চারশো থেকে পাঁচশো আখড়া তৈরি হয় পুণ্যার্থীদের সেবা করার জন্য।

Advertisement

অনেকে মনে করেন, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনে অগ্রদ্বীপে ভক্ত গোবিন্দ ঘোষের কাছে এসে ছিলেন শ্রীচৈতন্য। এখানে শ্রীচৈতন্যে একটি কৃষ্ণের বিগ্রহ তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নাম দেন গোপীনাথ। এই গোপীনাথের সেবার ভার গোবিন্দ ঘোষের হাতে দিয়ে তিনি নীলাচলে চলে যান। অনেকে মনে করেন, ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চৈত্রের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মারা হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং তাঁর অষ্ট পার্ষদের অন্যতম গোবিন্দ ঘোষ। তিনি ছিলেন গোপীনাথের সেবক। সেই তিথিকে স্মরণে রাখতে ফি-বছরই এই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক বা চিড়ে মহোৎসব। স্বয়ং গোপীনাথ এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন এবং শ্রাদ্ধকালীন কাছা ধারণ করেন। গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পিণ্ডদানের জন্যই এই আয়োজন। কেন এমন প্রথা? জনশ্রুতি আছে, শিশুপুত্রের মৃত্যুর পরে শোকে পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল গোবিন্দ ঘোষের। সেই সময়ে গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনিই পুত্র হিসেবে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন। সেই কথা মেনে গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে তাঁর শ্রাদ্ধ করেন গোপীনাথ। অনেকে বলেন, একমাত্র এখানেই নাকি ভগবান ভক্তের শ্রাদ্ধ করেন। সেই প্রথা এখনও চলছে।

প্রায় ৪৩১ বছর ধরে এই মেলা ধারাবাহিক ভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে। আগে অগ্রদ্বীপের খ্যাতি ছিল ছিল বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই। এই বারুণী স্নান হয়, চৈত্রের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে। জনশ্রুতি আছে, এই উৎসবের সূচনা শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের অনেক আগেই। বহু দিন থেকেই বাংলা, বিহার, বাংলাদেশ এবং ওডিশার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নানে শামিল হতে আসতেন।

Advertisement

রেভারেন্ড ফাদার জেমস লঙের ‘দ্য ব্যাঙ্কস অব ভাগীরথী’ থেকে জানা যায়, ১৮২৩ সালে অগ্রদ্বীপের এই গোপীনাথ-বারুণী মেলার আগত ভক্তের সংখ্যা ছিল এক লক্ষের বেশি। বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক বারো লক্ষ টাকারও বেশি। সেই সময় নাকি, গঙ্গাসাগর মেলার থেকেও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের খ্যাতি বেশি। এই স্নানে কেউ কেউ গঙ্গাবক্ষে সন্তান বিসর্জন দিতেন। জেমস লঙ লিখেছেন, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চৈত্রে অগ্রদ্বীপে ও কাটোয়ায় দু’টি নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল। যশোর ও ঢাকা থেকে এসে দু’জন তাঁদের সন্তান গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিয়েছিলেন।

এখন যে জমির উপরে গোপীনাথের মন্দির রয়েছে সেখানে ছিল একটি আধুনিক কাপড়ের কল।১৮২৮ সালে বিধ্বংসী বন্যায় ও ভাগীরথী বারবার বাঁক পরিবর্তনের ফলে কৃষ্ণচন্দ্র রায় নির্মিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরটি গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখনকার মন্দিরটি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে ছিল কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের তৈরি মন্দিরটি। ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল যশোরের বগচর নিবাসী গোপীনাথ পোদ্দারের অর্থানুকূল্যে । তিনি ১৮২৩ সালে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা দান করেছিলেন। কালীপ্রসাদ পোদ্দার বাংলাদেশের ভক্তদের অগ্রদ্বীপে গোপীনাথের মেলা ও বারুণীর স্নানে উৎসবে আসার সুবিধার জন্য একটি রাস্তা তৈরি করে দেন বলে জানা যায়। এ ছাড়াও কালীপ্রসাদ পোদ্দার বননবগ্রাম থেকে চাকদহ পর্যন্ত আরও একটি রাস্তা তৈরি করান। এই রাস্তাটির দৈর্ঘ্য প্রায় কুড়ি মাইল। পথিকের ক্লান্তি দূর করার জন্য প্রতিটি রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন তিনি। এখন মেলার জৌলুস বেড়েছে। কিন্তু যাঁদের জন্য আজ মেলার এই খ্যাতি তাঁদের ভুললে চলবে না।

‘দ্য ইনস্টিটিউট অব গোপীনাথ-গোবিন্দ ঘোষ রিসার্চ সেন্টার’, কাটোয়া শাখার অধ্যক্ষ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement