ছোটবেলায় চড়ুই আর বাবুইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রজনীকান্ত সেনের একটি ছোটদের কবিতার মাধ্যমে। ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামের সেই কবিতাটিতে চড়ুই পাখির অট্টালিকায় থাকার সুখ আর বাবুইয়ের নিজ বাসায় থাকার স্বাধীনতার কথা অসাধারণ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে চিত্রটা আমূল বদলে গিয়েছে। আজকের দিনে বাবুইয়ের যেমন স্বাধীনতা নেই, তেমনিই চড়ুইয়ের অট্টালিকার অহঙ্কারও শেষ হয়ে হয়ে গিয়েছে মানুষের আগ্ৰাসন আর সর্বগ্ৰাসী লোভের ফলে।
চড়ুইয়ের সংরক্ষণের জন্য ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২০ মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস হিসেবে পালিত হয়। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও মানুষ ভাবতে পারেনি চড়ুইয়ের মতো ছোট্ট এবং অতি সাধারণ একটা পাখি এত দ্রুত বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং একে সংরক্ষণের জন্য একটি দিনকে আন্তর্জাতিক চড়ুই দিবস হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪৮ ধরনের চড়ুই দেখা যায়। আন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেই চড়ুইয়ের দেখা মেলে। আমরা মূলত যে সব চড়ুইয়ের সঙ্গে পরিচিত সেই গৃহস্থালির চড়ুই (হাউজ় স্প্যারো) ও মাঠ চড়ুইয়ের
কথাই বলব।
চড়ুই মূলত পুরনো বাড়িঘরের কার্নিশে, প্রাচীন মন্দিরের খাঁজে, যেখানে একটু গাছপালা আছে সেইরকম স্থানে বসবাস করে। শহর, গ্ৰাম সব জায়গাতেই এই পাখি দেখা যায়। মাঠ চড়ুই বা প্যাডি ফিল্ড পিপিট সাধারণত বড় গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। মাঠ চড়ুইকে অনেকেই ‘ধান তুলিকা’ বা ‘মাঠ তুলিকা’ বলে। এরা প্রধানত ঝাঁকে ঝাঁকে থাকে।
চড়ুই খুবই পরিবেশবান্ধব ও কৃষকবান্ধব পাখি। এরা ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে নেয়। এরা মূলত বিভিন্ন পোকার শুককীট, ল্যাদাপোকা-সহ আরও কিছু ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উপকার করে। এরা খেতের নানা রকম অপকারী আগাছার দানা খেয়েও কৃষকের উপকার করে। এরা শস্য দানা খায় ঠিকই, কিন্তু তার পরিমাণ খুবই সামান্য। পোকামাকড়, দানা শস্য সব মিলিয়ে একটা চড়ুই পঁচিশ গ্রামের বেশি খাদ্য গ্রহণ
করতে পারে না।
এই পাখিটি মোটামুটি ১৬ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২৫ থেকে ৪০ গ্রাম ওজনের হয়। স্ত্রী চড়ুই ধূসর বাদামি ও পুরুষ চড়ুই ধূসর বাদামি রঙের সঙ্গে কিছুটা কালো রঙের হয়। দেহের রঙের সঙ্গে পাকা ফসলের রঙ মিশে থাকায় এরা শিকারি পাখিদের থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। মানুষের কাছাকাছি থাকা এই পাখিটি প্রতিকূল পরিবেশে খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
চড়ুই বছরের একাধিকবার প্রজনন করে। এক এক বারে এরা চার থেকে ছ’টি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও স্ত্রী চড়ুই দু’জনে মিলেই ছানা লালন-পালন করে। তিন সপ্তাহের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। সাধারনত ৭০ শতাংশ ছানাই বেঁচে থাকে। চড়ুই সাধারণত চার থেকে পাঁচ বছর বাঁচে।
চড়ুই আমাদের কতখানি উপকার করে একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যাবে। ১৯৫৮ সালে চিনের কৃষিবিদদের একাংশ মাও সে তুং-কে বোঝালেন এক একটি চড়ুই বছরে চার থেকে পাঁচ কিলোগ্রাম শস্য দানা খেয়ে ফেলে। এই শস্য রক্ষা করতে পারলে তা দিয়ে আরও ৬০ হাজার মানুষের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। মাও সে তুং এর নির্দেশে সমগ্র চিন জুড়ে শুরু হল চড়ুই নিধন যজ্ঞ। এল চড়ুই নিধন বাহিনী। শব্দ শুনে ভয়ে পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাকে অসংখ্য চড়ুই মারা পড়ে। চড়ুইয়ের বাসা ধ্বংস করে সমস্ত ডিম ভেঙে ফেলা হয়। বাকি যা চড়ুই বেঁচে ছিল ফাঁদ পেতে ও বিভিন্ন উপায়ে তাদেরও মেরে ফেলা হয়। এভাবে সমগ্র চিন চড়ুইমুক্ত করা হয়। এই ঘটনা সমগ্র বিশ্বের কাছে ‘গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেন’ নামে
পরিচিত হয়।
কিন্তু এরপর ১৯৬২ সালে ফসলে পোকামাকড়ের উপদ্রব প্রচণ্ড বেড়ে যায়। ফলে, প্রায় সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং সমগ্র চিন জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেই দুর্ভিক্ষে দু’কোটিরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে চড়ুই নিয়ে এসে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়।
এ হেন কৃষকবন্ধু তথা পরিবেশবান্ধব পাখিটিকে আমরা নানা ভাবে বিলুপ্ত করে ফেলছি।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার অধ্যাপক ডক্টর কৌশিক প্রামাণিকের মতে ‘‘খেতে অত্যধিক কীটনাশক ব্যবহার চড়ুই পাখি বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া বিগত দিনের ঘর বাড়িতে যে ঘুলঘুলি ছিল সেগুলো চড়ুই পাখির বাসা তৈরির জন্য আদর্শ ছিল। বর্তমানে যে ভাবে ঘর বা ফ্ল্যাট বানানো হচ্ছে সেখানে ঘুলঘুলি থাকে না। ফলে তা চড়ুইয়ের বাসা তৈরির উপযুক্ত নয়। প্রাকৃতিক উপায়ে ফসলের ক্ষতিকারক কীট ও আগাছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চড়ুইকে রক্ষা করতেই হবে। তা না হলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে মানুষ-সহ সমস্ত জীব জগতই বিপদের সম্মুখীন হবে।’’
রেডিও ফিজিক্সের অধ্যাপক ডক্টর সেঁজুতি খাঁড়া মনে করেন ‘‘বসতি এলাকায় ঘন ঘন মোবাইল টাওয়ারের ফলে এর ক্ষতিকারক লো লেভেল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি চড়ুইয়ের স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করছে এবং এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এদের প্রজনন ক্ষমতারও ক্ষতি করছে। এছাড়া মোবাইল টাওয়ারের এই ফ্রিকোয়েন্সির ফলে চড়ুইয়ের দিক নির্ণয় ক্ষমতা ও দক্ষতাও ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর ফলে চড়ুই খুব সহজেই শিকারি পাখিদের শিকার হচ্ছে। এটাও চড়ুই বিলুপ্তির
অন্যতম কারণ।’’
একদিকে আধুনিক প্রযুক্তি অন্যদিকে মানুষের সীমাহীন লোভে চড়ুই পৃথিবী থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমের দেশগুলিতে ‘স্প্যারো পাই’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ। এর জন্য চোরাপথে লক্ষ লক্ষ চড়ুই চালান করা হয়। এছাড়াও আমেরিকারতে ধুমায়িত বা স্মোকড চড়ুই একটি জনপ্রিয় পদ। পৃথিবীর বহু দেশেই চড়ুইয়ের মাংস বলবর্ধক মনে করা হয়। ফলে এখনও ফাঁদ পেতে চড়ুই ধরে নির্বিচারে হত্যা
করা চলছে।
সুরেলা কন্ঠের চঞ্চল এই ছোট পাখিটি নানা ভাবে জীববৈচিত্রকে রক্ষা করে। মানুষেকে ভালবেসে মানুষের কাছাকাছি আশ্রয় নিয়ে এখন মানুষের জন্যই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এরা। বিহার সরকার চড়ুইকে রাজ্য পাখির মর্যাদা দিয়ে চড়ুই নিধন বন্ধ করেছে। গুজরাট সরকারও চড়ুই সংরক্ষণে নানা রকম ব্যবস্থা
গ্রহণ করেছে।
তাই দেরি না করে আমাদেরও চড়ুই সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বাড়ির কার্নিশে, এলাকার গাছপালাতে চড়ুইয়ের কৃত্রিম বাসা বানিয়ে দিতে হবে। সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে চড়ুইয়ের হত্যা বন্ধ হয়। চড়ুই যে মানুষের কাছে এসে ভুল করেনি, এটা প্রমাণ করার
দায় মানুষেরই।