অসহন

ক্রোধ থাকিলেই গুলি ছুড়িয়া হত্যা করিতে হইবে, ইহা কিছু দিন পূর্বেও তেমন সম্ভাব্য বলিয়া মনে হইত না, আধুনিক পৃথিবীতে ইহা বেশ পরিচিত কার্যসূচি হইয়া উঠিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮ ০০:৪২
Share:

ছবি: রয়টার্স।

আমেরিকায়, ওয়াশিংটন ডিসি-র নিকটে, ‘ক্যাপিটাল গেজ়েট’ সংবাদপত্রের অফিসে ঢুকিয়া এক ব্যক্তি গুলি ছুড়িতে লাগিল, পাঁচ জন কর্মী নিহত হইলেন। যে ব্যক্তি গুলি ছুড়িয়াছে, সে তাহার এক সহপাঠিনীকে অনুসরণ ও উত্ত্যক্ত করিত, তাহা লইয়া এই কাগজে রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছিল, এই কাগজের বিরুদ্ধে সে মামলাও করিয়াছিল এক সময়ে। ক্রোধ থাকিলেই গুলি ছুড়িয়া হত্যা করিতে হইবে, ইহা কিছু দিন পূর্বেও তেমন সম্ভাব্য বলিয়া মনে হইত না, আধুনিক পৃথিবীতে ইহা বেশ পরিচিত কার্যসূচি হইয়া উঠিতেছে। এক বিশ্লেষক বলিয়াছেন: বহু মানুষ, অনেক সময় স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট, বলিয়া চলিয়াছেন যে সংবাদমাধ্যম হইল জনগণের শত্রু। গণমাধ্যমকে ভিলেন ঠাহরাইবার এই প্রবণতা, সেই মনোভাবের আগ্রাসী প্রশ্রয়, এই ধরনের হিংস্র কাজের অনুপ্রেরণা হইতেই পারে। সংবাদমাধ্যমের প্রতি বৈরিতা হইতে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলিও মুক্ত নহে। যদি কোনও কাগজ বা টিভি চ্যানেল আঞ্চলিক বা কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি সিদ্ধান্ত বা বক্তব্যের প্রবল সমালোচনা শুরু করে, তখন তাহাদের যুক্তি তথ্য বিশ্লেষণের বিরোধিতা না করিয়া, প্রথমেই বলা হয়, তাহারা দেশদ্রোহী, বা অন্য দলের হইয়া কাজ করিতেছে। তাহাদের অভিযোগের নেপথ্যে নিহিত স্বার্থ আবিষ্কারের, চক্রান্ত উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা হইতে থাকে। কেহ আমার নিন্দুক হইলেই সে নিশ্চয় অন্যের হাতে ঘুষ খাইতেছে, এই মতামত বড় সহজ ও সস্তা, সর্বোপরি এই মতে অটল থাকিলে অভিযোগের উত্তর দিবার দায় হইতে রেহাই পাওয়া যায়। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কেহ লিখিলে ট্রাম্প বলেন সে আমেরিকার বিরুদ্ধে কাজ করিতেছে, বিজেপির অপছন্দসই মতামত ব্যক্ত করিলে তাহাকে এই দেশ ছাড়িয়া পাকিস্তানে চলিয়া যাইতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের এই সঙ্কীর্ণ ও একবগ্গা অবস্থান সাধারণ নাগরিকের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া আশ্চর্য নহে। হয়তো কিছু মৌলবাদী নহে, অনেকেই মনে করে, সমালোচক সংবাদপত্রের দফতরে গুলি চালানোই তাহার শ্রেষ্ঠ সমালোচনা।

Advertisement

অসহিষ্ণুতা যখন মাথা চাড়া দেয়, সর্ব স্তরে ছড়াইয়া পড়িতে থাকে। কিছু দিন পূর্বে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি এক রেস্তরাঁয় খাইতে গিয়াছিলেন, তাঁহাকে মালিক আসিয়া সেই রেস্তরাঁ হইতে বাহির করিয়া দেন। ট্রাম্পকে কাহারও অপছন্দ হইতেই পারে, তাঁহার কোনও কর্মীর মতামত তাঁহার সহ্য না হইতেই পারে, কিন্তু তাহা বলিয়া সেই মানুষটি রেস্তরাঁয় খাইলে সেই আনন্দ-আহার ব্যাহত করা এক প্রকাণ্ড অভদ্রতা। প্রকৃত সহিষ্ণু ও প্রগতিশীল মানসিকতা বলে, প্রতিটি মানুষের অধিকারগুলিকে সম্মান করিতে হইবে, অপছন্দের মানুষ হইলে তাহা অধিক পরিমাণে খেয়াল রাখিতে হইবে। ট্রাম্প-বিরোধী যদি ট্রাম্প-সমর্থক দেখিলে শান্তিতে দোকানে জামা কিনিতে না দেন, তবে তাঁহার সহিত ট্রাম্পের পার্থক্যই বা কী হইল?

ভারতে অবশ্য বন্দুক লইয়া ঘোরাফেরা বিশেষ হয় না, সংবাদপত্রকর্মীদের মধ্যাহ্নভোজকালীন বেঘোরে খুন হইয়া যাইবার সম্ভাবনা কম। মতামতের ভিত্তিতে হয়তো দামি রেস্তরাঁ হইতে বাহিরও করিয়া দেওয়া হইবে না। কিন্তু সহসা, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি শুরু হইয়া যাইতে পারে। ইহা এক অন্য প্রকারের অসহিষ্ণুতা, বলা যাইতে পারে ইহা অধিক অশিক্ষিত। পূর্বোক্ত ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে শত্রুতার তবু ভিত্তি রহিয়াছে, এইখানে তাহাও নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া, দুই জন নিরীহ মানুষকে গাড়ি হইতে টানিয়া নামাইয়া বা এক ব্যক্তিকে গাছে বাঁধিয়া গণপ্রহার শুরু করিবার কালে হিংস্রতার উদ্‌যাপন কিছু মাত্রায় কম নহে। সন্দেহ হয়, ছেলেধরা সন্দেহটাই এই ক্ষেত্রে বড় কথা নহে, হত্যা করিবার অজুহাতটাই বড়। সম্প্রতি ত্রিপুরায় এই ছেলেধরা-বিষয়ক রটনার বিরুদ্ধে সরকারি প্রচারের কার্য ন্যস্ত হইয়াছিল এক ব্যক্তির উপর, যিনি মাইকে করিয়া এই ধরনের ব্যবহার হইতে নিরস্ত থাকিবার বার্তা দিতে গ্রামে গ্রামে যাইতেছিলেন, তাঁহাকেও ওই একই সন্দেহে গণপ্রহারে হত্যা করা হইল। এই তীব্র হিংস্রতাও রাষ্ট্রের উচ্চ স্তর হইতে নিঃসৃত হইয়া নিম্নে জনগণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইতেছে কি না, বলা কঠিন। তাহা অনেক সময় সাধারণ মানুষের অসভ্যতা ঢাকিবার অজুহাত বলিয়াও মনে হইতে পারে। কিন্তু এই সার্বিক অসহিষ্ণুতার উৎসব বন্ধ করিবার দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করিলে প্রকৃত কর্তব্য পালন করিত, সন্দেহ নাই।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

পটাপট দলগুলো হেরে বিশ্বকাপের বাইরে চলে যাচ্ছে, জার্সিগুলোও আর বিক্রি হচ্ছে না। যারা কিনে ফেলেছে, রাতে শোওয়ার সময় ছাড়া পরতে লজ্জা পাচ্ছে। দলগুলোরও বলিহারি, মাঠে নামছে অনেক সময় সম্পূর্ণ অন্য রকম জার্সি পরে। সারা জীবন যাকে দেখেছি নীল-সাদা, হঠাৎ কালোমতো কী পরল। ওদেরও হয়তো নানা ফ্যাশন করতে সাধ যায়, কিন্তু জার্সি বা পতাকা কি সাত রকম হতে আছে? এর পর তো প্লাস্টিক সার্জারি করে লোকে সোমে-মঙ্গলে মুখ পাল্টে ঘুরে বেড়াবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement