মিড ডে মিল। —ফাইল চিত্র
কথা হচ্ছিল ছোটদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প নিয়ে (‘ক্ষুধার রাষ্ট্রে জাতীয় মহিমা’, ৩১-১০)। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প দাঁড়িয়ে আছে এক মর্মান্তিক মিথ্যার উপর। প্রকল্পের কার্যবিধিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের পাঁচ খাতে ২২টা কর্তব্য নির্দিষ্ট আছে। তাঁরা শিশু ও সন্তানসম্ভবাদের খাবার ও ওষুধ দেবেন, তাঁদের স্বাস্থ্যের সার্বিক দেখভাল করবেন, শিশুদের যুগপৎ পড়া ও খেলার তত্ত্বাবধান করবেন, বাড়ি বাড়ি ঘুরে সকলের খোঁজ নেবেন, রিপোর্ট লিখবেন, নথি ও হিসাব সামলাবেন, ইত্যাদি। সচিবালয়ের কোনও কর্মীকে এমন দায়িত্ব একটার বেশি দুটো পালন করতে বললে বিদ্রোহ হবে। এই দশভুজারা কিন্তু খাতা-কলমে কর্মী নন, স্বেচ্ছাসেবক; অতএব এঁদের বেতনের প্রশ্ন নেই, জোটে কেবল ৪,৫০০ (কখনও ৩,৫০০) টাকার ‘সাম্মানিক’, সহায়কদের ২,২৫০ টাকা। অধিকাংশ রাজ্য নিজেদের তহবিল থেকে অঙ্কটা অল্পবিস্তর বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু অন্তত ১০টি রাজ্যে হাজার টাকা বা আরও কম পরিমাণে, তিনটিতে এক পয়সাও নয়।
অতএব বহু শিশুকেন্দ্র অবহেলা, এমনকি দুর্নীতির ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে, তা অপ্রত্যাশিত নয়; সর্বত্র হয়নি সেটাই আশ্চর্যের। অনেক কর্মী সামান্য মাইনের টাকা থেকে শিশুদের খাবার কেনেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ধারে সামগ্রী সরবরাহ করেন; অনুদান আসে বহু বিলম্বে। এটা সেই ব্যক্তিদের মহানুভবতার পরিচয়। কিন্তু যে দেশ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গল এ ভাবে ঈশ্বরের নামে ছেড়ে দেয়, তার নাগরিকেরা কী বলেন— সরকারের কাছে, নিজেদের কাছে?
মিড-ডে মিলের চিত্রটা ঠিক এক, বিস্তারে যাওয়ার দরকার নেই। ২০১৩-১৪’র তুলনায় ২০১৮-১৯’এ ব্যয় হয়েছে ১৪০০ কোটি টাকা বা ১৩% কম, ভোক্তা শিশুর সংখ্যা ১.৬৮ কোটি বা ১৫.৫% কম। মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ প্রাথমিকে ৪.৪৮ টাকা, উচ্চ প্রাথমিকে ৬.৭১ টাকা— ২০০৯-এর চেয়ে ১৬% বেশি, যদিও ইতিমধ্যে খাদ্যমূল্য বেড়েছে অন্তত ৪৫%। ২০১৫ সাল থেকে অধিকাংশ রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের আর্থিক দায় কমিয়েছে ৭৫ থেকে ৬০ শতাংশে। এ বার নতুন প্রস্তাব, শহরাঞ্চলে (ক্রমে হয়তো সর্বত্র) খাবার সরবরাহ আউটসোর্স করা হবে। সে ক্ষেত্রে বরাদ্দে ভাগ বসাবে সরবরাহকারীর মুনাফা, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে যেমন বসাচ্ছে বিমা সংস্থা আর বেসরকারি হাসপাতাল— সমীক্ষায় তা প্রকট ভাবে ধরা পড়েছে। তবে পাতে যা-ই পড়ুক, শ্রবণে অর্ধভোজন হতেই পারে। ওবেরয় হোটেলের শেফরা মিড-ডে মিলের এক লোভনীয় মেনু প্রস্তুত করেছেন। তাতে ডিমের মতো অপবিত্র খাদ্য নেই, কিন্তু আছে ফুলকপি কড়াইশুঁটির ডালনা, কাজু দিয়ে মাশরুম মটর, পলক পনির, ঘিয়ে রাঁধা কিশমিশ-বাদাম দেওয়া সুজির হালুয়া। বিশ্বাস হচ্ছে না? মিড-ডে মিলের ওয়েবসাইট দেখুন।
মধুরেণ সমাপয়েৎ করলে ভাল লাগত, কিন্তু দুটো কথা না বললেই নয়। এক, অর্থাভাবের অজুহাত যেন কেউ না তোলে। অন্য নজির ছেড়ে দিচ্ছি, সম্প্রতি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীদের ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। সেটা করায়ত্ত করে তারা কবুল করছে, লগ্নি করে কর্মসংস্থান বাড়াবার অবস্থায় তারা নেই। এর অর্ধেকের কম টাকায় ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ (যা এ বছর সামান্য কমেছে)
দ্বিগুণ করা যেত। সিকি ভাগের অনেক কমে অঙ্গনওয়াড়ি ও মিড-ডে মিল, উভয়ের বরাদ্দ হত দ্বিগুণ। বুলেট ট্রেনের প্রত্যক্ষ বাজেট এক লক্ষ কোটি, অর্থাৎ এই তিন জনকল্যাণ প্রকল্পের মোট বাৎসরিক বরাদ্দের সমান।
দ্বিতীয় কথাটা আরও অস্বস্তিকর। আজ দলমত নির্বিশেষে শাসক মহলে দেখা যাচ্ছে এক নতুন আগ্রাসী মনোভাব— শাসানি নজরদারি কড়াকড়ি, নাগরিক পরিসর সঙ্কোচন,
তথ্য যুক্তি আলোচনায় প্রায় মারমুখী বিতৃষ্ণা। একমাত্র জপমন্ত্র হল বৃদ্ধি বিকাশ উন্নয়ন, চুলোয় যাক বাক্স্বাধীনতা মানবাধিকারের বিলাস। আমরা প্রজারাও বলতে শিখেছি, ধর্মকথা ঢের শুনলাম, এ বার চাই জবরদস্ত শাসন।
কিন্তু এত করে যদি দেখা যায় কাজের কাজ হচ্ছে না, দেশবাসীর অবস্থা করুণ, কোটি কোটি শিশুর ভরপেট খাবার নেই, অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হয়। অমর্ত্য সেনকে ব্রাত্য প্রতিপন্ন করার প্রবল চেষ্টা চলছে, তবু মনে পড়ে তাঁর একটা পুরনো কথা: উন্নয়নের জন্য, এমনকি নিছক পেটের তাগিদে, গণতন্ত্র অপরিহার্য। মুক্ত যোগাযোগ ও সংবাদ প্রচারের অভাবেই চিনের মহান উল্লম্ফনের সময় দেড় কোটি মানুষ নিঃশব্দে অনাহারে মরেছিলেন; অপর দিকে, এই ব্যবস্থাগুলো ছিল বলে ভারতে অন্তত প্রকট ব্যাপক দুর্ভিক্ষের পালা সাঙ্গ হয়েছে।
সত্যিই হয়েছে তো? উপরের সংখ্যাগুলো কিন্তু চিন্তায় ফেলে। বিশ্বের বহু দেশে আজ দ্রুত নানা রূপান্তর ঘটছে, এক দশক আগে যা অকল্পনীয় ছিল। ভারতেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পট আমূল পাল্টেছে; তার সূত্র ধরে অর্থনীতি, নাগরিক সুখদুঃখ, শেষ অবধি নিছক মানবিক আবহ পাল্টাতে বাধ্য। এ সব নিয়ে আজ যদি না ভাবি, যে তথ্য এখনও সহজলভ্য তা খতিয়ে না দেখি, বেয়াড়া চিন্তাগুলো আপদ ভেবে দমিয়ে রাখি, কাল কিন্তু সুযোগ পাব না। জানতেও পারব না কোথায় কী ঘটছে, কী নিঃশব্দ বিপর্যয় হয়তো আমাদের ধাওয়া করছে। তার পর এক দিন আপদটা নিঃশব্দেই আমাদের ঘরে সেঁধিয়ে যাবে, বা হয়তো ঢুকবে রীতিমতো দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক