জীর্ণ: দেউলের বর্তমান অবস্থা।নিজস্ব চিত্র
জিন শহর। প্রথম শোনায় নামটা অদ্ভুত লাগবে। যদি নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে ভুল বোঝার সম্ভাবনাও প্রবল। কিন্তু জিন শহর আসলে এক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় সমৃদ্ধির কথা বলে। নামের মধ্যে দিয়ে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস বয়ে চলেছে জনপদটি।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর ১ ব্লকের কংসাবতী নদীর তীরে জৈন সংস্কৃতির চিহ্ন বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে জিন শহর। খড়্গপুর-মেদিনীপুর সড়কপথে কাঁসাইয়ের উপর বীরেন্দ্রসেতু বা মোহনপুর সেতু থেকে উত্তর-পূর্বে কাঁসাইয়ের বাঁধ বরাবর চার কিমি এগোলে পৌঁছনো যাবে জিন শহরে। জিন শহর, শহর নয়। আদতে নদীপ্রান্তের গ্রাম। কাঁসাই তীরের বালিহাটিতে আছে আরেক জৈন দেউলের ধ্বংসাবশেষ। এখানকার দেউলও ছিল বেশ বড়। দেউলের ভিতর ছিল কষ্টিপাথরের এক বিশাল মহাবীরের মূর্তি। বালিহাটির জৈন দেউল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে মাকড়াপাথরের চানগুলি। মহাবীরের মূর্তি পুরাতত্ত্ব বিভাগ নিয়ে গিয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি।
পৌরাণিক কপিশা নদী, বর্তমানের কাঁসাই তীরের জিন শহরে একসময় জৈন ধর্মালম্বীদের বসবাস ছিল। তখন অবশ্য নাম ছিল অন্য। জৈনদের বসতি ছিল বলে নাম হয়েছে জিন শহর। পূর্বে এটি ছিল নদীপথের এক সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ও ঘাট। যেখানে ঘাঁটি তৈরি করেছিলেন বিশিষ্ট বণিকেরা। তাঁরা জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরাই নির্মাণ করেছিলেন দেউল। জৈনরা কোথা থেকে এসেছিলেন কংসাবতী বা কপিশা নদীর তীরে? নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, খ্রিস্ট-পূর্ব আড়াইশো-তিনশো বছর থেকে খ্রিস্টোত্তর এক হাজার বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারত তথা বাংলায় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল। ভারতের ধর্মীয় বিবর্তনের মূল কেন্দ্র প্রাচীন বিহারে প্রায় দু’হাজার পাঁচশ বছর পূর্বে জৈনধর্মের প্রচলন হয়। জৈনধর্মে মোট চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর হলেন ঐতিহাসিক চরিত্র। মহাবীর ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক।
তীর্থঙ্করদের মধ্যে কুড়িজনই ‘কেবলজ্ঞান’ বা ‘সর্বজ্ঞতা’ লাভ করেছেন বিহারের (বর্তমান ঝাড়খণ্ডের) পরেশনাথ পাহাড় বা শমেতশিখরে। কেবলজ্ঞান লাভের পর তীর্থঙ্করেরা সশিষ্য ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জনপদে যেতেন। কেবলজ্ঞান লাভের পূর্বে ও পরে মহাবীর রাঢ়ভূমিতে এসেছিলেন। যোগেশচন্দ্র বসুর ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ অনুযায়ী, রাঢ়ভূমি বলতে এখনকার সমগ্র পশ্চিমবঙ্গকে বোঝাত। দক্ষিণ রাঢ়ের দামোদর, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা নদী ও এদের উপনদীর অববাহিকায় পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও অখণ্ড মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় জৈনধর্ম ছড়িয়ে পড়ে।
রাঢ়দেশে জৈন ধর্মের বিস্তার ঘটলেও কাঁসাই তীরে এই ধর্মের সর্বাধিক প্রসার ঘটেছিল। পুরুলিয়ার দেউলঘাটা, আড়শা, ছর্রা, পাকবিড়্রা, বাঁকুড়ার অম্বিকানগর, মণ্ডলকুলি, ডুমুরতোড়, ঝাড়গ্রামের ডাইনটিকরি, উড়লিডাঙা, করাতশোলের সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের জিন শহর, বালিহাটির জৈন মূর্তি ও জৈন দেউলের ধ্বংসাবশেষ তারই প্রমাণ।
‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকায় ১৯৭৯ সালের মার্চ সংখ্যায় বিশিষ্ট মন্দির গবেষক মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান দেউলটি নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন রাজ্য পুরাতত্ত্ব সচিব পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত দেউলটি ঘুরে দেখেছিলেন। তাঁর মতে, এটি খ্রিস্টীয় দশম শতকে নির্মিত। দেউল-সহ জমিটির বর্তমান মালিক নিমাইচন্দ্র বাকলি। দেউলটি পূর্বমুখী এবং ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির। আয়তনে বেশ বড়, দ্বিতল, তিন কক্ষবিশিষ্ট। খিলান করা ছাদ। দেওয়াল ও ছাদ মাকড়া পাথরের। দক্ষিণ থেকে উত্তরে বারান্দা-সহ দু’টি কক্ষ। তারপর একটি ভিতর বারান্দা, যার বাঁদিকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। তার পর সমকোণে বেঁকে পূর্বদিকে প্রসারিত তৃতীয় কক্ষ। মাঝের ঘরটি গর্ভগৃহ। কাঁসাই ও দামোদরের তীরে যে সব জৈন দেউলের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় তাদের কোনটাতে তিন কক্ষ বা সিঁড়ি নেই। সেদিক থেকে দেউলটি স্বতন্ত্র ও বিশেষত্বের দাবি রাখে। দেউলের দক্ষিণের কক্ষটি প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
গর্ভগৃহে বেদির উপর পদ্মাসনে উপবিষ্ট ধ্যানরত মাকড়া পাথরের এক তীর্থঙ্করের মূর্তি। উচ্চতায় প্রায় আড়াই ফুট। সময়ের প্রভাবে ক্ষয়েছে মূর্তি। তাতে অবয়ব একেবারে অস্পষ্ট। অনুমান, এটি ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের মূর্তি। বোঝা যায়, মূর্তিটির অবস্থান ছিল অন্য কোনও দেউলে। হতে পারে এই দেউলেরই অন্য কোথাও। দেউল ত্যাগের সময় জৈনরা তাঁদের দেবমূর্তি নদীতে বিসর্জন দিতেন। কাঁসাইয়ের তীরে যত মূর্তি দেখা যায় সেগুলি পাওয়া গিয়েছে নদীগর্ভ থেকে। কয়েক বছর আগে জিন শহরের কাছে নদী থেকে একটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।
কাঁসাইয়ের তীরে প্রাপ্ত বিভিন্ন তীর্থঙ্কর মূর্তিগুলোকে স্থানীয় বাসিন্দারা পুজো করেন। ঝাড়গ্রাম জেলার উড়লিডাঙায় তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ পূজিত হন বাবা ধন্বন্তরী রূপে। করাতশোলে পার্শ্বনাথ পূজিত হন মা বাসুলি রূপে। নেপুরাতে জৈনদেবী পদ্মাবতী পূজিত হন খাঁদারানি রূপে, বাঁকুড়ার ডুমুরতোড়ে পার্শ্বনাথ পূজা পান বাবা কালামদন নামে। পুরুলিয়া শহরে আদিনাথ পূজিত হন মা খেলাইচণ্ডী নামে। এই জেলার ছর্রায় পার্শ্বনাথের নাম ধর্মঠাকুর, দেউলিতে শান্তিনাথ পূজিত হন ইর্গুনাথ নামে। জিন শহরের তীর্থঙ্কর মহাবীর কোন পুজো পান না।
রেলশহর খড়্গপুরের মালঞ্চ-খরিদা অঞ্চলে বহু জৈন ধর্মাবলম্বীর বাস। মালঞ্চে আছে পঞ্চান্ন বছরের পুরনো ‘শ্রী দিগম্বর জৈন তেরাপন্থী মন্দির’ ও ধর্মশালা। মন্দিরে ১৬তম তীর্থঙ্কর শান্তিনাথ, প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথ এবং ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি রয়েছে। পরিচালনা করে ‘শ্রী দিগম্বর জৈন সোসাইটি’। সোসাইটির বর্তমান সভাপতি অরুণকুমার জৈন বাকেবেরিয়া বললেন, মন্দিরে চব্বিশ তীর্থঙ্করেরই মূর্তি স্থাপনের কাজ চলছে। খড়্গপুর অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দিগম্বর জৈন ও আড়াইশ শ্বেতাম্বর জৈন থাকেন। জৈনরা আছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদাতে এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটে। দু’টি জায়গাতে তাঁরা মন্দির নির্মাণ করেছেন। শরৎসেতু নির্মাণকালে রূপনারায়ণ নদে পাওয়া অষ্টম তীর্থঙ্কর চন্দ্রপ্রভর হলুদাভ পাথরের সুদর্শন মূর্তি স্থাপিত হয়েছে কোলাঘাট জৈন মন্দিরে।
কিন্তু জিন শহর নাম হল কেন? সংস্কৃত ‘জিন’ কথাটির অর্থ জয়ী। যিনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে পার্থিব পুনর্জন্মের প্রবাহ থেকে মুক্তিলাভ করেন তিনিই জিন। জৈন তীর্থঙ্করদের প্রত্যেকেই জিন। জিনের অনুগামী জৈন এবং তাঁদের অনুসৃত ধর্ম জৈনধর্ম।
বিভিন্ন স্থানে পুরাতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহ্যপূর্ণ সৌধ হিসেবে জৈন দেউল সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু নানা সমস্যায় জিন শহরের দেউল জীর্ণ।
লেখক লোকসংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক