মাঘমেলার উদ্বোধনে রাজ্যপাল এবং উপাচার্য। বৃহস্পতিবার। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।
পৌষমেলার প্রচার আর জনপ্রিয়তার আবহে বরাবরই চাপা পড়ে যায় শ্রীনিকেতনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মেলা, মাঘমেলা। অথচ এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবি রবীন্দ্রনাথের কর্মীসত্তা, পল্লী পুনর্গঠনের স্বপ্ন। সেই প্রেক্ষিতেই প্রায় শতবর্ষ আগে, ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে বিশ্বভারতীর ইতিহাসে। ওই দিন শ্রীনিকেতন পল্লী-পুনর্গঠন বিভাগ স্থাপিত হল সুরুল কুঠিবাড়িতে। শুরু হল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের পল্লীসংস্কার ও গ্রামোন্নয়নের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পল্লীপুনর্গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যেতে পারত, নিদেনপক্ষে বিলম্বিত হতে পারত, যদি একটি টেলিগ্রামের জবাব আসতে দেরি হত।
লেনার্ড এলমহার্স্ট তখন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যার পাঠ শেষ করে ইয়র্কশায়ারের বাড়িতে ফিরে বিব্রত হয়ে আছেন পারিবারিক বিবাদে। ততদিনে তিনি মনস্থ করে ফেলেছেন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে গ্রামসংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। তখনই শান্তিনিকেতন থেকে টেলিগ্রাম এল অ্যান্ড্রুজের, যার সারমর্ম, টাকা নেই, আসতে হবে না। কিন্তু, হতাশ হননি এলমহার্স্ট। দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের শুভানুধ্যায়ী পিয়ার্সনের সঙ্গে, তাঁর ম্যাঞ্চেস্টারের বাড়িতে। তাঁর পরামর্শমতো রবীন্দ্রনাথকে কেব্ল পাঠিয়ে জানালেন, কবির পল্লীসংস্কার ও কৃষির উন্নতির স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণের জন্য মিসেস স্ট্রেট (ডরোথি স্ট্রেট) কৃষি-যন্ত্রপাতির সম্ভার জাহাজে পাঠানোর সম্পূর্ণ খরচ (সে কালের প্রায় ছশো পাউন্ড) দিতে সম্মত হয়েছেন। আমন্ত্রণ যদি এখনও অটুট থাকে, তাহলে এলমহার্স্ট শান্তিনিকেতনে আসতে চান। অভিভূত রবীন্দ্রনাথ ফিরতি কেব্লে উত্তর দিলেন, ‘ডিলাইটেড, কাম, ইনভিটেশন হোল্ডস’।
২৭ নভেম্বর ১৯২১। শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছলেন শ্রীনিকেতনের ভবিষ্যৎ রূপকার। পরের দিন সাক্ষাৎ হল ‘পোয়েট’ আর ‘প্লাওম্যানের’। রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠালেন সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে, এলমহার্স্টকে সমর্পণ করলেন তাঁর হাতে। সন্তোষচন্দ্রের সঙ্গে সুরুলের খামারবাড়ি দেখেই এলমহার্স্টের মনে হল, যে কাজের জন্য তিনি এসেছেন, তার আদর্শ জায়গা এটাই।
শ্রীনিকেতনের কাজ প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়েছিল পাঁচ-ছ’জন ছাত্র এবং বারো জন কর্মী নিয়ে। এলমহার্স্ট তাঁদের বলেছিলেন, ‘ইন্টিমেট কোলাবোরেটর’। শ্রীনিকেতনের কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এই অন্তরঙ্গ সহযোগীর সংখ্যা অনেকটা বেড়ে যায়। এলমহার্স্ট পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়লেন। প্রথমে সুরুলের গ্রাম পুনর্গঠন কেন্দ্রের নাম স্থির হয়েছিল ‘স্কুল অব এগ্রিকালচার’। রবীন্দ্রনাথকে আচার্য করে এলমহার্স্ট, সন্তোষচন্দ্র, রথীন্দ্রনাথ ও গৌরগোপাল ঘোষকে নিয়ে কর্মসমিতি গঠিত হল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, মাদ্রাজি খ্রিস্টান কে টি পল, মাইকেল স্যাডলার এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর লিবার্টি হাইড বেইলিকে নিয়ে ট্রাস্টি গঠনের প্রস্তাব নেওয়া হল। কিন্তু, সে দিন রবীন্দ্রনাথের কোথাও একটা দ্বিধা ছিল যে, ব্রিটিশ প্রশাসকেরা ‘নিউ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ অনুযায়ী গ্রাম পঞ্চায়েত ঠিক ভাবে গঠন করতে গড়িমসি করবে। তাই, রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা ছিল, শ্রীনিকেতন পরিচালন পর্ষদে বেশি সংখ্যায় ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারীকে অন্তর্ভুক্ত করলে প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মকানুনের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। তবে, এলমহার্স্ট তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, অভারতীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ নিলে সেই অর্থের সদ্ব্যবহার প্রমাণ করার জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমর্থন দরকার। তাই পর্ষদে বিদেশিদেরও রাখা হত।
পল্লী পুনর্গঠনের এই কর্মোদ্যোগে গ্রামবাসীদের উজ্জীবিত করতে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব ছিল, লন্ঠন-বক্তৃতা, খেলা, অভিনয় ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের সামগ্রিক ভাবে শামিল করা দরকার। তাই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন হোক। সুরুলের এই বার্ষিক মেলাই শ্রীনিকেতনের আজকের মাঘমেলার আদি সংস্করণ। তবে ১৯২২-এর ৬ ফেব্রুয়ারিই যে আনুষ্ঠানিক ভাবে শ্রীনিকেতনে পল্লী পুনর্গঠনের সূচনা হয়েছিল, তার কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। এই উপলক্ষে কোনও অনুষ্ঠান বা বক্তৃতাদি হয়েছিল কিনা, জানা যায় না। শান্তিনিকেতন পত্রিকা, রবীন্দ্রনাথের পত্রাদি বা এলমহার্স্টের ডায়েরি— কোনও সূত্রেই একেবারে নির্দিষ্ট করে দিনটির কথা পাওয়া যায়নি। বরং তথ্য বলছে, সুরুল সমিতির প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২-এর জুলাই মাসে। তবে, স্বয়ং এলমহার্স্ট তাঁর শ্রীনিকেতনের ডায়েরি-তে উল্লেখ করেছেন যে, ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি, রথীন্দ্রনাথ এবং জাপানি দারুশিল্পী কাসাহারা সুরুলে সব দেখেশুনে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের পাকড়াও করেন। সেদিনই মধ্যাহ্নভোজের পরে শান্তিনিকেতন গৃহের দ্বিতলে সব ছাত্র এবং পরিচালন সমিতির সব সদস্যকে নিয়ে পল্লীপুনর্গঠন সংক্রান্ত আলোচনা ও তার রূপরেখা তৈরি হয়। তার পরে দু’টি নতুন ফোর্ড লরিতে করে ছাত্রেরা মালপত্র নিয়ে রওনা হলেন আর এলমহার্স্ট চললেন পিছনে সাইকেল নিয়ে। কর্মযজ্ঞের সমস্ত কর্মকর্তা আর কর্মীরা পরের দিন, অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই কাজ শুরু করলেন। বোধহয় এ কারণেই ৬ ফেব্রুয়ারি দিনটিকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠাদিবস হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিন্তু তখনও স্থানটি শ্রীনিকেতন নাম পায়নি। যদিও রবীন্দ্রনাথ একে শ্রীনিকেতন নামে চিহ্নিত করেছিলেন ১৯১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, গীতালি-র পাণ্ডুলিপিতে তার উল্লেখ আছে। সত্যদাস চক্রবর্তী তাঁর ‘শ্রীনিকেতনের গোড়ার কথা’-য় লিখেছেন, ‘১৯২৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারিখে বিশ্বভারতী সোসাইটির বার্ষিক পরিষদের সভায় সোসাইটির সংবিধি সংশোধনকালে সুরুল সমিতির পরিবর্তে শ্রীনিকেতন সমিতি কথাটির সর্বপ্রথম উল্লেখ দেখা যায়। শ্রীনিকেতনের ইনস্টিটিউট অব রুরাল রিকনস্ট্রাকশন কথাটিও সেই সময়ে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়।’
এর পর থেকেই চিরাচরিত প্রথায় ৬ ফেব্রুয়ারিই শুরু হচ্ছে শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্যাপন ও মাঘমেলা, এ বার যা ৯৮ বছরে পড়ল। ভারতবর্ষের পল্লী উন্নয়নের আদর্শের অন্যতম বড় আর সার্থক রূপায়ণ এই শ্রীনিকেতনে। কর্মী রবীন্দ্রনাথের এই হল আপন ভূমি। তাই শ্রীনিকেতনের ভিতরের কথাটি ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের গানে, ‘ফিরে চল মাটির টানে, যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’
লেখক বিশ্বভারতীর পল্লী সম্প্রসারণ কেন্দ্রের শিক্ষক