তখন শুরু হয়েছে খাদ্য আন্দোলন। ১৯৫৯ সালের ২০ অগস্ট মুর্শিদাবাদ-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আদালত এবং বিডিও অফিসে আইন অমান্য করে বহু আন্দোলনকারী স্বেচ্ছাসেবক গ্রেফতার হন। এই গণ আন্দোলনের ব্যাপকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে রাজ্য সরকার। রেশন ব্যবস্থা অনিয়মিত হয়ে যায়। সমাজের সকল স্তরের মানুষ তখন চরম খাদ্য সঙ্কটে জর্জরিত এবং হতভম্ব। খাদ্য সমস্যায় বাদ পড়েনি জেলার ‘মূক ও বধির’ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই দুঃসময়ে প্রধান শিক্ষক সহকর্মীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মূকও বধির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তিনি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতেন।
বহরমপুরের রাধারঘাট ভট্টাচার্যপাড়ায় যোগমায়া গৃহে এই মূক ও বধির স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৩৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। মাসিক ৬ টাকা ভাড়া বাড়িতে মূক ও বধির দু’জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্কুল শুরু করেন গোপাল দাস নিয়োগী চৌধুরী। সৈদাবাদের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অনেকেই ভাবলেন, এটা গোপালবাবুর পাগলামি। নাগপুরের একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরিও পেয়েছিলেন। কিন্তু সুহৃদ কালিদাস ভট্টাচার্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার মূক ও বধির বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অটলচাঁদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পরামর্শ নিতে ছুটে যান। তাঁরই নির্দেশে দিল্লিতে মূক ও বধির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে থাকার সময় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সান্নিধ্যে আসেন।
কৈশোর ও যৌবনে সৈদাবাদ খাগড়া এলাকায় প্রায় প্রতিটি সেবামূলক কাজে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করতেন। হয়ত সেই মহৎ আদর্শই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল মূকও বধির বিদ্যালয় গড়ে তুলতে। প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব পালন করা ছাড়াও সহশিক্ষক, করণিক, পিওন ও ঝাড়ুদারের কাজও একা তাঁকেই সামলাতে হত। মূক ও বধির সংসারের মহান দায়িত্ব নিয়ে তিনি এক কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন। তাঁর কর্মকুশলতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সাহায়্য করতে শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা এগিয়ে এলেন।
১৯৩৪ সালের ১১ নভেম্বর কাশিমবাজার মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীকে সভাপতি, অম্বিকাচরণ রায়কে সহ সভাপতি এবং বিশ্বনাথ রায়কে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হল। কিছু দিন পরে সহকর্মী হিসাবে পান শৈলেশকুমার রাহা, সুধীরকুমার চৌধুরী, নৃপেন্দ্রকুমার দাস, গোবিন্দচন্দ্র দাস প্রমুখকে।
১৯৩৪ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত গোপালবাবু তাঁর সহকর্মীদের সহায়তায় যোগমায়া বাড়িতেই মূক ও বধির স্কুল চালু রাখেন। কিন্তু যোগমায়ার অস্থায়ী কুটিরে বিদ্যাভাসের পথটি মোটেই মসৃণ ছিল না। বরং প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল কণ্টকাকীর্ণ এবং ব্রিটিশ শাসকের সন্দেহের বাতাবরণে আচ্ছন্ন। তাদের ধারণা ছিল, ছাত্র-শিক্ষকের আকার- ইঙ্গিতে ও ইশারায় বুঝি বিপ্লবী কার্যকলাপের নতুন কোনও কৌশল। কিন্তু না, গোয়েন্দা বিভাগের গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান উপলব্ধি করে যে যোগমায়ার উন্মুক্ত প্রাঙ্গন সারস্বত সাধনার পীঠস্থান, বৈপ্লবিক অনুশীলন সমিতির আখড়া নয়। ফলে খোলা মনে নিবিড় অনুশীলনে এগিয়ে চলল সরস্বতী বন্দনার বিজয়রথ। এক দিন সুদীর্ঘ সংগ্রামের পূর্ণ স্বীকৃতির সূর্যকিরণ দেখা দিল। জেলাশাসক অশোক মিত্রের উদ্যোগে, রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কাটজু ও মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কালো মেঘ দূর হয়। রাজ্য সরকার নিজস্ব চৌহুদ্দিতে বিদ্যালয়ের জন্য ভবন তৈরির শর্তে ১৯৫৬ সালের ১৭ডিসেম্বর দেড় লক্ষ টাকার অনুদান মঞ্জুর করেন। স্বপ্ন ও বাস্তবের যোগসূত্র রচিত হল।
অবশেষে বহরমপুরের মোহন রায় পাড়ায় ১৯৫৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কাশিমবাজারের মহারাজ কুমার সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দী মায়ের নামে নামকরণের শর্তে ১০ বিঘা জমি দান করলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণ হল ‘মহারাণী নীলিমাপ্রভা মূক ও বধির বিদ্যালয়’। কিছু দিন পরে রাজ্য সরকারের দেওয়া টাকায় পাঁচ কক্ষের বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হয়। কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া ১৯৬০ সালের ২৭ জুন ভাড়ার ঘর ত্যাগ করে নতুন ভবনে বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হল। সার্থক হল গোপাল দাস নিয়োগী চৌধুরীর তপস্যার প্রথম সোপান। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে মূক ও বধির ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করল। বিদ্যালয় যেন তীর্থভূমিতে পরিণত হল।
শিক্ষকতায় গোপাল দাস নিয়োগী চৌধুরীর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতিও ছিল যেমন অভিনব, বোঝানোর কায়দা ও ধৈর্যও ছিল দেখার মতো। শিক্ষাদানে তিনি পেতেন পরম তৃপ্তি। তাঁর স্নেহস্পর্শে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল নিষ্ঠা, অধ্যাবসায়ের মূর্ত প্রতীক। প্রধান শিক্ষক হিসাবে স্কুল পরিচালনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করতেন না। এক বার স্কুলের করণিক পদের ইন্টারভিউয়ে পদপ্রার্থী হিসাবে এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন পরীক্ষার্থীরাও উপস্থিত হন। কিন্তু তিনি প্রতিবন্ধী এক কর্মপ্রার্থীকে মনোনীত করার জন্য ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে বলেন, ‘‘প্রতিবন্ধীদের স্কুলে প্রতিবন্ধী প্রার্থীকেই সুযোগ দেওয়া উচিত।’’ তাঁর জীবন সাধনা ছিল সমাজে যাঁরা উপেক্ষিত, অবহেলিত তাঁদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মূক ও বধির দেবীরানি রায়কে। নিঃস্বার্থ জীবন সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’ এবং ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হন। অবশেষে আত্মপ্রচার বিমুখ এই মহৎ মানুষটির বৈচিত্রময় কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল। কিন্তু এই শিক্ষকের অবসর পরবর্তী জীবন মোটেই সুখকর ছিল না। ৪৮০ টাকা বেতনে অবসর গ্রহণ করার পরে জোটেনি কোনও পেনসন ভাতা। ১৯৬৬ সালের ১ এপ্রিল (অর্ডার নং: ১৬১০-ই.ডি.এন.(এস)/আই.ই-১৪/৬৭, তাং: ১৮.৭.৬৮) থেকে পেনসন রুলস বলবৎ থাকলেও রাজ্য সরকারের কাছে অনেক আবেদন নিবেদনের পর ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শরণাপন্ন হন। ভাগ্যের কী করুণ পরিহাস! তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর দফতর থেকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে মাত্র ২০০০ টাকার চেক পাঠানো হয়। তিনি সমাজের অবহেলিত মূক ও বধির বালক-বালিকাদের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করলেও নিজে কিন্ত অর্থনৈতিক অনটনের গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যান। ১৯৮৪ সালের ১৪ জানুয়ারি মারা যান গোপাল দাস নিয়োগী চৌধুরী।
শিক্ষক, কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
তথ্য: নীলিমাপ্রভা মূক ও বধির বিদ্যালয় সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক পত্রিকা। কৃতজ্ঞতা: বারীন্দ্র রায়, সুব্রত দত্ত, পঙ্কজ সরকার, আফতাব হোসেন ও দেবাশিস নন্দী।