দ্বন্দ্বসমাস: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত এবং মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি
সে দিন নিউ জার্সি থেকে বন্ধুবর নিখিলেশ ফোন করেছিল। তথ্যপ্রযুক্তি জগতের লোক। বেশ কয়েক বছর দেশে আসেনি, কিন্তু শিকড় আলগা হয়নি।
“দেশে হচ্ছেটা কী রে? মোহন ভাগবতের পর এখন দেখছি বিশ্ব হিন্দু পরিষদও জানিয়ে দিল সামনের বছর থেকেই অযোধ্যায় রাম মন্দির গড়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে। ব্যাপারটা কী? আবার?”
বললাম, শুধু এটাই দেখলি। মোহন ভাগবতের মন্তব্য প্রচারিত হওয়ার এক ঘন্টার মধ্যেই মুসলিম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি-র বিবৃতি দেখিসনি? ওয়াইসি পালটা হুংকার দিয়ে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের শুনানি হওয়ার আগেই এ কথা বলে সংঘ আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। আমরা বিতর্কিত স্থলে মন্দির হতে দেব না। অন্য দিকে, বিজেপি বলছে, রামমন্দির নির্মাণ মানুষের বিশ্বাসের অন্তঃস্থলে। তাই মন্দির হবেই।
গুজরাত নির্বাচনের আগে বিকাশপুরুষ নরেন্দ্র মোদীর শাসক দল বিজেপির এ এক অসাধারণ কুনাট্য। ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার দিন। ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে শুনানি। ৯ ডিসেম্বর গুজরাতে ভোট।
মোহন ভাগবত এবং ওয়াইসি একই মুদ্রার দুটি পিঠ। ওয়াইসির সঙ্গে অধুনা বিজেপির সম্পর্ক অতি-ঘনিষ্ঠ। এই সাংসদ যে দলের নেতা, তার নাম মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও অসমের নির্বাচনে ওয়াইসিসহ কিছু মুসলিম নেতার সাম্প্রদায়িক প্রচার বিজেপির হিন্দুত্ব প্রচারের অনুকূল হয়ে ওঠে। অ-বিজেপি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে ছেড়ে সংখ্যালঘু ভোটার যদি এই মুসলিম দলগুলিকে ভোট দেয়, তবে বিজেপির সোনায় সোহাগা। যে সব রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটার কম, সেখানেও এই বনামের রাজনীতি বিজেপির পক্ষে মন্দ কী? রাম-রহিম বিভাজনের রাজনীতিতে উগ্র হিন্দুয়ানাকে মূলধন করে বিজেপি তার ভোটের তরীতে সোনার ফসল তুলতে পারে।
ওয়াইসি শিক্ষিত ও মার্জিত সাংসদ। মাথায় ফারের টুপি, কালো লম্বা কোট আর সাদা চোস্ত পরেন তিনি। আতর মাখানো ছুঁচলো দাড়ি। তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলি, দারুণ চিত্তাকর্ষক। অনেক পড়াশোনাও করেন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে। গীতা ও কোরান নিয়েও। কিন্তু যখনই তিনি হায়দরাবাদের চারমিনারে অথবা লখনউয়ের ইমামবাড়ার কাছে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা দেন, তখন মুসলিম সমাজের রক্ত গরম করে দেন উগ্র বক্তৃতা দিয়ে।
বিজেপির এক শীর্ষ নেতাকে এক বার বলেছিলাম, এহেন ওয়াইসিকে এত গুরুত্ব দেন কেন? আপনারা ওঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ মনে করেন না? শীর্ষ নেতাটি পোহা খেতে খেতে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক তো বটেই। একদম দেশদ্রোহী। লেকিন দেশ মে হমারে পার্টি কে বিকাশ কে লিয়ে ওয়াইসি বহুত ফায়দামন্দ হ্যায়।’’ আপাতত বিজেপির ওয়াইসিকে প্রয়োজন। এটাই হল অমিত শাহের আর্ট অব ওয়র।
আরও পড়ুন: কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ম্যাজিক নয়
‘পদ্মাবতী’ ছবি নিয়ে রাজস্থানে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। ছবিতে কী আছে কী নেই তা জানার দরকার নেই। সত্য কী, তাও অবান্তর। ভোটের জন্য এই কুসংস্কার এই রোষ— উচ্চ ফলনশীল। ২০১৪ লোকসভা ভোটে এই ধর্মীয় মেরুকরণের কৌশলেই উত্তরপ্রদেশের ভাল ফল। সংখ্যালঘু তোষণ, মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা আর হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন— সবই তাত্ত্বিক দলীয় কর্মসূচি। বাস্তবে উত্তরপ্রদেশে যখন হিন্দু জাঠ বনাম সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়, তখন তা বিজেপির হাত আরও শক্তিশালী করে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনেও অমিত শাহ একই কৌশল প্রয়োগ করে ব্যর্থ হন। গির্জায় হামলা, সাধ্বী নিরঞ্জনের ‘হারামজাদা’ উক্তি, হিন্দুদের চার সন্তান বাধ্যতামূলক করার বিবৃতি জারি করেও বিজেপি কেজরীবাল নামক অজানা ঝড়কে রুখতে পারেনি। বিহারেও হিন্দুত্বের কৌশল পরাস্ত হয় জাতপাতের অঙ্কে। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে অমিত শাহ তাই শুধু মেরুকরণের রাজনীতিতে নির্ভর না করে, নোট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে মায়াবতী-মুলায়মের নির্বাচনী তহবিলকে আচমকা নিজস্ব করে দিয়ে আবার বাজিমাত করেন।
গুজরাত নির্বাচনের ফলাফল কী হবে জানি না। নিজে গুজরাতে যাইনি। বিজেপির শীর্ষ নেতারা ভয়ে ভয়ে আছেন। আবার কংগ্রেস শিবির বলছে, রাহুল গাঁধীর প্রচার সফল, মানুষের অসন্তোষও সত্য। তবে ধর্মীয় মেরুকরণের গণউন্মাদনার সঙ্গে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস সফল হতে পারে
কি না সেটাই এখন দেখার। ভোটের ফল যা-ই হোক, আপাতত সাম্প্রদায়িকতার তাসকে এমন নগ্ন ভাবে ব্যবহার করা দেখে আমি বিস্মিত নই, কিন্তু বিষাদগ্রস্ত।
কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পাঠক, আপনারা বাংলায় বসে হিন্দি বলয়ের এই ধর্মীয় উন্মাদনার বিদঘুটে রাজনীতিটা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ এবং সুভাষচন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষ মননের মধুতে বাঙালি বড় হয়েছে। আমরা গর্বিত। বাংলায় ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা কম হয়নি। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও ওয়াইসির দলের কার্যকলাপকে উসকে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু পরে রাজ্য বিজেপি নেতারা বুঝতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গে ওয়াইসিদের ব্যবহার করার কৌশলে হিতে বিপরীত হতে পারে, কারণ বাঙালি হিন্দু সমাজ ঠিক হিন্দি বলয়ের মতো নয়।
এত বছর দিল্লিতে থেকে বুঝেছি, রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ থেকে গুজরাত— হিন্দু জনসমাজের মধ্যে আছে তীব্র কুসংস্কার। রাজস্থানে আজও বহু গ্রামে সতীদাহের সমর্থনে উৎসব হয়। সতীর আত্মত্যাগের মহিমা কীর্তন হয়। তেমনই, যে পদ্মাবতী কোনও বাস্তব চরিত্রই নয়, তাঁকে দেবী বলে পুজো করে বহু মানুষ। এই ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করেই এ দেশটাকে এক হিন্দু-পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। ১৮৫৫ সালে এক বার অযোধ্যায় দু’পক্ষের সংঘাতে বহু লোক মারা যায়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্রিটিশ রাজশক্তি। আবার, ১৯৪৯ সালে এই মসজিদ প্রাঙ্গণে রাতের অন্ধকারে রামলালার মূর্তি স্থাপন করেছিল কিছু মানুষ। সমস্যার অবসান মোদীর আধুনিক ভারতেও হল না। এই পশ্চাৎমুখী অন্ধ কুসংস্কারই বিজেপির নির্বাচনী সিদ্ধিলাভের পথ।
জাহানারা আত্মকথায় লিখেছেন, আকবর নাকি দেশ শাসনের আদর্শ তুলে ধরতে বার বার সম্রাট অশোকের বহুত্ববাদের কথা স্মরণ করতেন। অশোক থেকে আকবর। তার পর গাঁধী-নেহরুর ভারত। আজ এ দেশের বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপক্ষতার সামাজিক কাঠামোকে নস্যাৎ করে দিয়ে ভারত নামক ধারণাটির ইতি টানতে চলেছেন অমিত শাহরা। আপাতত তাই বিকাশের কাহিনি ভুলে যান। গণউন্মাদনাই শেষ কথা।
ট্রাম্পের দেশে বসবাসকারী বন্ধুবর নিখিলেশের খুব মন খারাপ।