ধরা যাউক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যদ্রষ্টা। সত্যই তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েত ভোটে একশো শতাংশ আসনে জয়ী হইল। ধরা যাউক, সেই জয়ে সন্ত্রাসের কোনও দাগ থাকিল না, সাধারণ মানুষই তাঁহাদের ভোট দিয়া জিতাইয়া আনিলেন। তবুও সেই জয় কি সব প্রশ্নের উত্তর হইতে পারে? মানুষের ভোটে একশো শতাংশ আসনে জয় যে কথাগুলি জানাইবে, তাহা এই রূপ: এক, দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ আছে; দুই, মানুষ এই দলের উন্নয়ন কর্মসূচিতে (রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া থাকা উন্নয়ন নয় অবশ্য) ভরসা করিয়াছে; তিন, বিরোধীরা এখনও তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে নাই। সমস্ত ভোটদাতা সত্যই অবাধে ভোট দিতে পারিবেন, এমন আশা অনুব্রত-অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে হয়তো বাতুলতার নামান্তর। কিন্তু, তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, সত্যই ভোটের দিন প্রশাসনের সদিচ্ছা জাগিবে, মেরুদণ্ড গজাইবে এবং মানুষ নিজের ভোট দিতে পারিবেন। কিন্তু, সেই ভোটে জয়ও বলিবে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে সফল হইয়াছিলেন কি না। গণতন্ত্র যে নিরপেক্ষতা দাবি করে, প্রশাসক হিসাবে তিনি তাহার তিলমাত্র নিশ্চিত করিতে পারিয়াছিলেন কি না। মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস করিবার বিন্দুমাত্র সুযোগ দিয়াছিলেন কি না। ভোটের ব্যালট এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে না। উত্তর পশ্চিমবঙ্গবাসী জানেন। একশো শতাংশ আসনে জিতিয়া আসিলেও সেই উত্তর বদলাইবে না।
কথাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্ভবত জানেন। যেমন জানেন নরেন্দ্র মোদী আদি নেতারা, অথবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ন্যায় প্রাক্তনরা। তাঁহারা জানেন, ভোটের ফলাফলে প্রশাসক হিসাবে নৈতিকতার, ন্যায্যতার বিচার হয় না। তবুও, অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠিলেই তাঁহারা গণদেবতার দোহাই দেন। ‘মানুষের আদালতের বিচার’-এর উপর আস্থা জ্ঞাপন করেন। কারণ, তাঁহারা জানেন, উহাই একমাত্র পরীক্ষা, যাহার ফলাফল জনসমক্ষে আসে। অন্য পরীক্ষাগুলি মহাকালের খাতায়। সেই প্রশ্নগুলির বিচার গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাহার কোনও নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি নাই। এবং, সেই পরীক্ষায় ডাহা ফেল করিলেও ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিতে কোনও সমস্যা হয় না। নরেন্দ্র মোদী যেমন তাঁহার জমানার যাবতীয় অ-শাসনকে অস্বীকার করিয়া চলিতেছেন ২০১৯-এর আশায়। সেই নির্বাচনে যদি তিনি জিতিয়া ফিরেন, তাহা কি প্রশাসক হিসাবে তাঁহার যাবতীয় ব্যর্থতাকে মুছিয়া দিবে? মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান, গৌরী লঙ্কেশ হইতে কাঠুয়া-কাণ্ড, কোনও দায়ই তাঁহার থাকিবে না? গণতন্ত্রকে লুণ্ঠিত করিবার অভিযোগ হইতে তিনি নিষ্কৃতি পাইবেন? উত্তরগুলি তিনিও জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন।
গণতন্ত্রের পরীক্ষার সঙ্গে তাঁহাদের বিরোধ একেবারে মূলে। একশো শতাংশ আসন দখল করিবার অদম্য তাগিদে। গণতন্ত্রের পরিসরটি শুধু বিজয়ীর নহে, বিজিতেরও। শাসকের পাশাপাশি বিরোধীও গণতন্ত্রে সমান জরুরি। জনগণের যে অংশ শাসকদের সহিত একমত নহেন, সমর্থক নহেন, শুধু তাঁহাদের প্রতিনিধিত্ব করিবার জন্যই নহে, বিরোধীর প্রয়োজন শাসকের গঠনমূলক সমালোচনা করিয়া চলিবার জন্যও। ভারতে এই কথাটি যিনি অন্য অনেকের তুলনায় ঢের বেশি জানিতেন, তাঁহার নাম জওহরলাল নেহরু। কিন্তু এই ভারত তাঁহাকে মুছিয়া ফেলিতে বদ্ধপরিকর। বিরোধীদের সূচ্যগ্র জমিটুকুও ছাড়িতে না চাওয়াও সেই প্রবণতারই শরিক। জমি না ছাড়িবার তাগিদই সেই কাজগুলি করাইয়া লয়, যাহাতে বারংবার কালি পড়ে গণতন্ত্রের মুখে। সেই কালিতে সম্ভবত নেতাদের কিছু যায় আসে না। ভোটের ফলাফলই তাঁহাদের মোক্ষ। মহাকালের বিচার নহে।