বিতর্কিত সেই হোর্ডিং। —ফাইল ছবি
আদালত নাক না গলাইলেই মঙ্গল, জানাইয়াছেন উত্তরপ্রদেশের অ্যাডভোকেট জেনারেল রাঘবেন্দ্র প্রতাপ সিংহ। কয়েক দিন পূর্বে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ লখনউ-এর রাস্তায় রাস্তায় একটি হোর্ডিং লাগাইয়াছিল। তাহাতে বেশ কয়েক জন নাগরিকের ছবি, সঙ্গে তাঁহাদের নাম ও ঠিকানা। নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনে তাঁহারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করিয়াছিলেন বলিয়া পুলিশের অভিযোগ। রাস্তায় হোর্ডিং টাঙাইয়া পুলিশ তাঁহাদের ক্ষতিপূরণ জমা করিতে বলিয়াছে। দৃশ্যত বিচলিত এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে রাজ্য প্রশাসনকে জবাবদিহি করিতে বলে। তাহারই উত্তরে অ্যাডভোকেট জেনারেলের এই মন্তব্য। তিনি আরও জানাইয়াছেন, ভবিষ্যতে কেহ যাহাতে এ-হেন আচরণ করিবার সাহস না পায়, তাহা নিশ্চিত করিতেও এই ব্যবস্থা জরুরি। গণতন্ত্রের সৌভাগ্য, আদালত এই পরামর্শে কর্ণপাত করে নাই। রাজ্য সরকারকে কঠোর তিরস্কার করিয়া আদেশ দিয়াছে, অবিলম্বে এই হোর্ডিংগুলি সরাইয়া ফেলিতে হইবে। কারণ, ইহা নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করে। আদিত্যনাথের সরকার অবশ্য পাল্টা বলিতে পারিত, হোর্ডিং টাঙাইয়া দেওয়া তো নিতান্ত কোমল শাস্তি— তাহারা রাতবিরেতে পুলিশ লেলাইয়া দিতে অভ্যস্ত।
গোটা দেশেই ‘দেশপ্রেমী’দের প্রাবল্য বিপজ্জনক, উত্তরপ্রদেশে তাহা আরও বেশি। ফলে, সিএএ-বিরোধী অতএব দেশদ্রোহীদের নামঠিকানা হাতে পাইলে কী হইতে পারে, আদিত্যনাথদের না জানিবার কথা নহে। অনুমান করা চলে, তাঁহারা সজ্ঞানেই কাজটি করিয়াছেন। হয়তো ভাবিয়াছেন, সব মারধরের দায় একা পুলিশের ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া উচিত হইবে না— কাহাদের শাসন করিতে হইবে, এইটুকু জানাইয়া দিলেই যদি বাকি কাজ হইয়া যায়, তবে আর পুলিশের হাতে বাড়তি রক্তের দাগ লাগাইবার প্রয়োজন কী? প্রশাসনের সিদ্ধান্তটি, অতএব, শুধু নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারভঙ্গ নহে, তাহা কার্যত গণপিটুনির আহ্বান। কোনও রাজ্য প্রশাসন যে এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করিতে পারে, কিছু দিন পূর্বেও তাহা দেখিলে অবাক লাগিত। ইদানীং সহিয়া গিয়াছে। রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হইলে প্রথম দায়িত্ব যে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হইতে বিরত থাকা, গণতন্ত্রের এই প্রাথমিক পাঠটিকেও আদিত্যনাথেরা সম্ভবত নেহরু-যুগের আবর্জনা জ্ঞান করিয়া থাকেন। পুলিশও রাজনৈতিক দলের বাহুবলী বা সাঙাতের ভূমিকাতেই মানাইয়া লইয়াছে— প্রশাসনের যে নিজস্ব কিছু নৈতিকতা থাকিতে পারে, এই বোধটিই লুপ্তপ্রায়। এই দফায় আদালত গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষা করিয়াছে। কিন্তু বিচারপতি লোয়া বা বিচারপতি মুরলীধরের উদাহরণগুলি এমনই জ্বলন্ত যে ভরসা পাওয়া মুশকিল।
আদিত্যনাথের শাসনকাল এতটা নৈতিকতাবিবর্জিত যে অধিক বাক্যব্যয় অর্থহীন। কিন্তু, লখনউয়ের রাজপথে যে ঘটনাটি ঘটিল, তাহা কি শুধুমাত্র আদিত্যনাথের হিতাহিতজ্ঞানের অভাবে? তেমন দাবি করা মুশকিল। গণতন্ত্রে বিরোধিতার পরিসর সম্বন্ধে দিল্লির অধীশ্বরদের এমনই অশ্রদ্ধা, সকল বিরোধিতাকেই তাঁহারা যে ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে দেখিতে অভ্যস্ত, সেই মানসিকতাটিই গোটা দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। আদিত্যনাথের ন্যায় অত্যুৎসাহীরা তাহাকে আরও কয়েক ধাপ আগাইয়া লইয়া গিয়াছেন মাত্র। শাসক আর দেশ যে দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অস্তিত্ব, শাসকের বিরোধিতার অর্থ যে দেশের বিরোধিতা নহে— বস্তুত, দেশের মঙ্গলকামনা করিলে কিছু ক্ষেত্রে যে শাসকের বিরোধিতা করাই দেশপ্রেমের প্রমাণ— এই কথাগুলি নাগপুরের পাঠশালায় শেখানো হয় না। কিন্তু, দেশ শাসন করিতে হইলে শাসককে কথাগুলি মনে রাখিতে হইবে— ইহা দেশের দাবি।