মহম্মদ শামি। —ফাইল চিত্র।
ফাইনাল শেষ। বিধ্বস্ত ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঢুকে প্রধানমন্ত্রী কী ভাবে নিজের বুকে টেনে নিলেন মহম্মদ শামির মাথা, সমাজমাধ্যমের কল্যাণে সেই ভিডিয়ো এখন দেখে ফেলেছেন অনেকেই। অনুমান করা চলে যে, ভিডিয়োটি নয়, প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন শুধু এই ছবিটি ছড়িয়ে পড়ুক মিডিয়ায় যে, তাঁর বুকে মাথা রেখে কাঁদছেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারি। হয়তো নিজেকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্নেহশীল অভিভাবক হিসাবে দেখাতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু, এই লেখা তাঁকে নিয়ে নয়— এ লেখার নায়ক মহম্মদ শামি। অতএব, অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে শুধু হাত মেলালেও প্রধানমন্ত্রী শামিকেই বুকে টেনে নিলেন কেন, এই প্রশ্নটা থেকেই শুরু করা যাক।
এই বিশ্বকাপের সেরা বোলার বলে? প্রথম চারটি ম্যাচে মাঠের বাইরে থাকতে বাধ্য হওয়ার পরও বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারি হয়েছেন বলে? না কি, তিনি মহম্মদ শামি বলেই— এ বছর মার্চেও আমদাবাদের দর্শকরা যাঁকে উত্ত্যক্ত করেছিলেন ক্রমাগত ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে, অথবা ২০২১ সালে পাকিস্তানের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারতের পরাজয়ের পর যাঁর বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিষ উগরে দিয়েছিলেন নব্য ভারতের অতিজাতীয়তাবাদী ভক্তবৃন্দ? আমদাবাদের নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে সে দিনও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘স্নেহশীল অভিভাবক’-এর মুখে একটি শব্দও শোনা যায়নি সে দিন— সান্ত্বনাও না, প্রতিবাদও না। তখন বিপর্যস্ত শামির পাশে দাঁড়ানোয় কোনও বাড়তি নম্বর ছিল না— তখনও অবধি শামিকে শুধু ‘এক মুসলমান খেলোয়াড়’ হিসাবে চিহ্নিত করা চলত। এই বিশ্বকাপের পর তাঁকে ‘জাতীয় নায়ক’-এর স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। শামি আসলে দেখালেন, আজকের ভারতে এক সংখ্যালঘুকে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়জনিত অসম্মানকে সরিয়ে ‘ভারতীয়’ হয়ে ওঠার স্বীকৃতি আদায় করতে কতখানি অতিমানবিক পারফর্ম্যান্স করতে হয়।
তিনি ভারতের সর্বকালের সেরা পেসারদের তালিকায় কত নম্বরে থাকবেন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাক। উত্তরপ্রদেশের অমরোহা থেকে পনেরো বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসা শামি কী ভাবে প্রতি ধাপে নিজেকে আরও ধারালো, আরও তীক্ষ্ণ ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন, তার অন্য এক উদাহরণ মিলবে আইপিএল-এ। ২০১৪ সালে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-এর হয়ে ১২টা ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন শামি। পরের বছর চোটের জন্য মাঠের বাইরে; তার পরের দু’বছরই আটটা করে ম্যাচ খেলে পেয়েছিলেন পাঁচটা করে উইকেট। ২০২৩ সালে গুজরাত টাইটান্স-এর হয়ে ১৬ ম্যাচে ২৮ উইকেট পেলেন, প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ। আগের বছর পেয়েছিলেন ২০টি উইকেট। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সাধনা ছাড়া এ জিনিস হয় কি?
সেই সাধনায় কোনও কাব্য নেই, বেদম পরিশ্রম আছে। নিতান্ত কৈশোরেই প্র্যাকটিস সেশন শেষ হওয়ার পর কোচের থেকে চেয়ে নিতেন পুরনো বলগুলো, তাতে রিভার্স সুইং অনুশীলন করবেন বলে। লকডাউনের সময় গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন শামি। বিশ্রাম নয়, দলের ফিজ়িয়োর সঙ্গে কথা বলে তৈরি করে নিয়েছিলেন অনুশীলনের উপযুক্ত পরিকাঠামো, যাতে খেলায় ফেরার সময় ফিটনেসের অভাব না ঘটে। বারে বারে চোটের মুখে পড়েছেন বলে আলাদা ভাবে যত্ন নিয়েছেন শরীরের। দল থেকে বাদ পড়েছেন যত বার, অভিযোগ করেননি— হাসি মুখে জলের বোতল বওয়ার পাশাপাশি বাড়িয়ে গিয়েছেন অনুশীলনের সময়। বিশ্বকাপের চারটি ম্যাচ ডাগ আউটে বসে থাকার পর প্রত্যাবর্তনের ম্যাচেই পাঁচ উইকেট পাওয়া— রূপকথার গল্প নয়, বহু ঘাম ঝরানোর পুরস্কার।
শামি হয়তো বলবেন, শুধু স্বেদ ঝরেনি, রক্তক্ষরণও হয়েছে অনেক। ২০১৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে গার্হস্থ হিংসার অভিযোগ এনেছিলেন স্ত্রী হাসিন জহান— শামির বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে তিনি আপত্তি করায় শামি নাকি তাঁকে মারধর করেন। সেই মামলা এখনও চলছে— হাই কোর্ট হয়ে তা সুপ্রিম কোর্টেও পৌঁছেছিল। গত সেপ্টেম্বরে নিম্ন আদালত তাঁর জামিন মঞ্জুর করেছে। একমাত্র কন্যা রয়েছে স্ত্রীর কাছেই। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি শামি দোষী না নির্দোষ, তা জানার উপায় নেই, অনুমান করার চেষ্টাও অবান্তর। কিন্তু, মনে রাখা ভাল যে, অভিযোগটি ওঠার পরই, ২০১৮ সালে, বিসিসিআই জানায় যে, শামির সঙ্গে আপাতত চুক্তি পুনর্নবীকরণ করছে না তারা। প্রায় এক বছর পরে সেই চুক্তি নবীকরণ হয়। শামি নিজেই জানিয়েছিলেন, অন্তত তিন বার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন তিনি। প্রতি বারই পরিবারের সদস্যরা তাঁর পাশে থেকেছেন, কখনও একা ছাড়েননি। আর শক্তি দিয়েছিল ঈশ্বরবিশ্বাস। শামি জানিয়েছিলেন, আধ্যাত্মিকতা থেকে তিনি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। বিশ্বকাপে তাঁর ফিরে আসার ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেওয়ার পর মাঠেই হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কি ঈশ্বরকেই ধন্যবাদ দিলেন তিনি?
তাঁর ক্রিকেটজীবন এখনও অনেক বাকি। শেষ পর্যন্ত তাঁর অর্জনের ঝুলি কতখানি ভরবে, ভবিষ্যৎই জানে। কিন্তু, মহম্মদ শামি একটা কথা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন— সাফল্যকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষও যার নাগাল পাবে না। প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হবেন তাঁর মাথা বুকে টেনে নিয়ে ছবি তুলতে।