বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। —ফাইল চিত্র।
মোট তিন দফায় ষোলো বছরেরও বেশি রয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পদে। তৃতীয় দফায়, চুয়াত্তর বছর বয়সে, সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হল বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে। অতি কৌশলে তিনি শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন, দেশের ভোটদাতাদের বুঝিয়েছেন যে একমাত্র তিনিই ইজ়রায়েলকে নিরাপত্তা দিতে পারেন। কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইজ়রায়েলের অভ্যন্তরে যে আক্রমণ করল, যাতে চোদ্দোশোরও বেশি ইজ়রায়েলি প্রাণ হারালেন, তা নেতানিয়াহুর ভাবমূর্তিতে ভাল রকম চিড় ধরাতে শুরু করল। ইজ়রায়েল অভেদ্য, নেতানিয়াহু থাকলে ইজ়রায়েলের মানুষ সুরক্ষিত থাকবে, এই বিশ্বাসে আঘাত হানল হামাস। ১৯৭৩ সালের পরে আর কখনও এত বিপন্ন হয়ে পড়েনি ইজ়রায়েল। সে বছর মিশর এবং সিরিয়া আক্রমণ করেছিল ইজ়রায়েলকে। ইয়ম কিপুরের সেই যুদ্ধ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, আঠারো দিনেই শেষ হয়েছিল। এ বার সংঘাত কোন পথে যাবে, কবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। ফলে প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল দেশটির জন্ম হয়, তার পরের বছর রাজধানী তেল আভিভে জন্ম হয় নেতানিয়াহুর। ১৯৬৩ সালে তাঁর বাবা, ইতিহাসবিদ বেঞ্জিয়ন, অধ্যাপনার সুযোগ পেয়ে সপরিবারে চলে যান আমেরিকায়। আঠারো বছর বয়সে তিনি দেশে ফিরে আসেন, এবং পাঁচ বছর সৈন্যদলে কাজ করেন। ইজ়রায়েলি সেনার অভিজাত কম্যান্ডো বিভাগ সায়ারেত মাটকাল-এ ক্যাপ্টেন ছিলেন। তবে ১৯৭৬ সালে তাঁর ভাই জোনাথনের মৃত্যু তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলে। উগান্ডার এনটেব-এ পণবন্দিদের উদ্ধার করার একটি মিশনে জোনাথন নিহত হন।
সেনাবাহিনী থেকে নেতানিয়াহু সরে আসেন কূটনীতিতে। এমআইটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে তাঁর, ইংরেজি বলায় অত্যন্ত দক্ষ, ফলে অচিরেই আমেরিকার টেলিভিশনে তিনি হয়ে ওঠেন এক পরিচিত মুখ। উনিশশো আশির দশকে তাঁকে ইজ়রায়েলের সপক্ষে সওয়াল করতে শোনা যেত নিয়মিত। রাজনীতিতে যোগ দেন ১৯৯০ সালে, যখন ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ ধাক্কা খায় হামাসের আক্রমণে। সেই সময়ে ইজ়রায়েলের কট্টরপন্থী লিকুদ দলে যোগ দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মহলে তাঁকে আপসহীন ‘হার্ডলাইনার’ বলেই দেখা হয়। আর নিজের দেশের মানুষের কাছে তিনি জাতীয়তাবাদী। ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রবিন, যিনি অসলোতে ইয়াসের আরাফতের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, নিহত হন এক দক্ষিণপন্থীর হাতে। শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল ওই আততায়ী। পরের বছর নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে লিকুদ পার্টি, প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হন নেতানিয়াহু। তখন তিনি ছিলেন সে দেশের সবচেয়ে কমবয়সি প্রধানমন্ত্রী।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর প্রধান অবদান, তিনি ইজ়রায়েলকে সরিয়ে এনেছেন এমন অবস্থানে যেখানে প্যালেস্তাইনের সঙ্গে শান্তি অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হানার আগে ইজ়রায়েল ক্রমাগত গাজ়ায় আরও বেশি ভূখণ্ড নিজেদের দখলে আনতে নিয়োজিত ছিল। নেতানিয়াহুর জীবনীকার আনশেল ফিফার লিখেছেন, “একমাত্র সেই শান্তির কথাই তিনি বিবেচনা করবেন, যেখানে ইজ়রায়েলের চাপে প্যালেস্তাইন সম্পূর্ণ নতজানু হতে বাধ্য হয়েছে।”
নেতানিয়াহু ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী পরিমণ্ডলে তিনি বড় হয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য, এবং ক্ষমতার প্রতি তাঁর অত্যন্ত আকর্ষণের জন্য তিনি বাধ্য হয়েছেন অতি-দক্ষিণপন্থী, ধর্মের বিষয়ে উগ্র মনোভাবাপন্ন দলগুলির সঙ্গে আপস করতে, এবং তাদের সঙ্গে মিলে সরকার গড়তে।
বর্তমান সঙ্কটের আগেও নেতানিয়াহু বেশ সমস্যার মধ্যে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। কিন্তু ২০২২-এ তৃতীয় বার নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সেগুলি চাপা পড়ে যায়। এ বছর তিনি পার্লামেন্টে এমন আইন পাশ করান, যার বলে দেশের আদালতগুলি কোনও সরকারি সিদ্ধান্তকে সহজে খারিজ করতে পারবে না। অভিযোগ ওঠে, এই আইন গণতন্ত্রের পরিপন্থী, প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
এখন নেতানিয়াহু সারা বিশ্বের প্রশ্নের মুখে। হামাসের আক্রমণের জবাবে ইজ়রায়েলের পাল্টা আক্রমণে এখনও পর্যন্ত গাজ়ায় সাত হাজারেরও বেশি প্যালেস্তাইনের বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। আমেরিকা যদিও এখনও অবধি ইজ়রায়েলের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লে হয়তো বিশ্বের ক্ষোভের সামনে দাঁড়িয়ে রাশ টানার পক্ষে সওয়াল করতে বাধ্য হবে।
নেতানিয়াহু যদি এ যাত্রা সন্তোষজনক ভাবে ‘যুদ্ধ’ শেষ করতে না পারেন, ইজ়রায়েলের মানুষের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হন, তা হলে বিরোধীদের পাশাপাশি তাঁর সমর্থক অতি-দক্ষিণপন্থীদের সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে। সেই ব্যর্থতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে দিতে পারে, ইজ়রায়েল খোঁজ করতে পারে নতুন কোনও নেতার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির পুরনো অভিযোগগুলিও ফের উঠে আসবে। সত্য প্রমাণিত হলে তাঁকে দীর্ঘ দিন জেলবন্দি থাকতে হতে পারে। প্রধানমন্ত্রিত্বের সুবিধা তিনি আর পাবেন না।
তবে কিনা, সব রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞকে ভুল প্রমাণিত করে ফের ইজ়রায়েলের রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসবেন নেতানিয়াহু, সেই সম্ভাবনাও রয়েছে দস্তুরমতো। চতুর নেতা তিনি। আর রাজনীতিতে তো চতুরতারই জয়জয়কার।