রবীন্দ্র-ভাবনায় শ্রীনিকেতনের কৃষি-পরিকল্পনা

শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলা যায়, নয় দশকেরও আগে রবীন্দ্রনাথ কৃষি, পল্লিপুনর্গঠন ও সামগ্রিক উন্নয়নের যে কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে শুরু করেছিলেন সমগ্র বিশ্বে তা প্রথম। লিখলেন অতনুকুমার সিংহ।শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলা যায়, নয় দশকেরও আগে রবীন্দ্রনাথ কৃষি, পল্লিপুনর্গঠন ও সামগ্রিক উন্নয়নের যে কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে শুরু করেছিলেন সমগ্র বিশ্বে তা প্রথম। লিখলেন অতনুকুমার সিংহ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০১:৩১
Share:

সুরুল খামারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাল চালানো (১৯২৯)। ছবি সৌজন্য: রবীন্দ্রভবন

প্রায় আশি বছরের জীবনকালে, রবীন্দ্রনাথের (৭ মে ১৮৬১—৭ আগস্ট ১৯৪১) সাহিত্যকর্ম ও ভাবনায় বৈচিত্র্য যেমন দেখা যায় তেমনি গঠনমূলক ও স্বাবলম্বী সমাজ সংগঠন ভাবনাতেও স্বকীয়তার অভাব নেই। এক জীবনে বিপুল সাহিত্যসম্ভার রচনার পাশাপাশি তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর গ্রামীণ ভারতবর্ষের পল্লিপুনর্গঠন নিয়ে ভেবেছেন এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে দুঃসাধ্য কর্মের ব্রত গ্রহণ করেছেন।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের পল্লিপুনর্গঠন কর্মসূচির মূলে ছিল একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজের উন্নতি — যেখানে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। শ্রীনিকেতন ছিল পল্লিগুলির জীবন ও জীবিকার উন্নতি ঘটানোর সোপান। শ্রীনিকেতন পরিকল্পনায় একদিকে ছিল সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তা আর অন্যদিকে ছিল শিলাইদহ-পতিসরে পারিবারিক জমিদারি দেখভালে পল্লিউন্নয়নের সাফল্য ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাই রবীন্দ্রনাথকে শ্রীনিকেতনে পল্লিউন্নয়নের সঠিক নীতি ও পন্থা নির্ধারণে সাহায্য করে।

জমিদারি দেখভালের সুবাদে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন, দেশের অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির উন্নতি হলেই দেশের উন্নতি ঘটবে। কৃষিবিদ্যায় স্নাতক হয়ে দেশে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষি ও পল্লিপুনর্গঠনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন— ‘আমি যে সব কাজ করতে চেয়েছিলুম কিন্তু এখনো হাত দিতে পারিনি, তোকে সেগুলি করতে হবে— বিশেষত কৃষির উন্নতির চেষ্টা করতে হবে।’

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ জমিদারকে ‘জমির জোঁক’, ‘প্যারাসাইট’ বা ‘পরাশ্রিত জীব’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের হাত থেকে নিরীহ পল্লিবাসীর মুক্তি চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির মধ্যে আমরা কৃষিতে মাটির গুরুত্ব, বিজ্ঞান সহায়ে চাষের ভাবনা, কৃষিতে সমবায় ভাবনা, জমিতে চাষির স্বত্ব, কৃষক-জীবনে মানোন্নয়নে লোকশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে দুটি পৃথক মেলার আয়োজন, কৃষিতে ‘হলকর্ষণ’, ‘বৃক্ষরোপণ’, ‘নবান্ন’এর মত উৎসবের সূচনা প্রভৃতি পল্লিপুনর্গঠনে তাঁর কৃষি-চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে।

১৯১২ সালে রায়পুরের জমিদার কর্নেল নগেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছ থেকে কেনা সুরুল কুঠিবাড়িতে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ কৃষি ও গোপালনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংগঠনের কাজের সূচনা করেন। প্রথমে এর নাম ছিল — ‘সুরুল ফার্ম’, কাগজপত্রে পরিচয় ছিল ‘ডিপার্টমেণ্ট অফ্ এগ্রিকালচার—শান্তিনিকেতন’। ডিসেম্বর ২২, ১৯২১ ‘বিশ্বভারতী সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হলে সোসাইটির বিধি অনুসারে ‘শান্তিনিকেতন কর্মসমিতি’ ও ‘সুরুল সমিতি’ (সুরুল এগ্রিকালচার বোর্ড) নামে দুটি পৃথক সমিতি গঠিত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১৯২৩ বিশ্বভারতী সোসাইটির বার্ষিক পরিষদের সভায় সংবিধান সংশোধনকালে ‘সুরুল সমিতি’র পরিবর্তে নামকরণ হয় ‘শ্রীনিকেতন সমিতি’। শ্রীনিকেতনের ‘ইনস্টিটিউট অফ্‌ রুরাল রিকনস্ট্রাকশন’ নামটিও এই সময় থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শ্রীনিকেতনের মর্মকথা ‘ফিরে চল মাটির টানে—/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে’ গানটি রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার এক মাস পরেই রচনা করেন (ফাল্গুন ২৩, ১৩২৮)। আমেরিকার কৃষি অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এল.কে. এলম্‌হার্স্ট, যিনি নিজেকে ‘চাষা’ বলে অভিহিত করতেন, শ্রীনিকেতনের প্রথম সচিব ও ডিরেক্টর নিযুক্ত হন এবং ১৯২১—১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি শ্রীনিকেতনে ছিলেন। লেনার্ড নাইট এল.কে. এলম্‌হার্স্ট এবং ডরোথি স্ট্রেটের আর্থিক আনুকুল্যে শ্রীনিকেতনে পল্লিপুনর্গঠন কাজের অগ্রগতি ঘটে।

পল্লিসংগঠন এবং কৃষি ও কৃষিসংক্রান্ত গবেষণার যে কর্মযজ্ঞ শ্রীনিকেতনের সূচনাপর্ব থেকে শুরু হয় তার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে। শ্রীনিকেতন সংলগ্ন গ্রামগুলির মূল জীবিকা কৃষিকে বাঁচাতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন — ‘গ্রামগুলি না বাঁচিলে বাংলা উৎসন্নে যাইবে’ (প্রবাসী পত্রিকা, ফাল্গুন ১৩৩৩)।

শ্রীনিকেতন কর্মকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ ‘ল্যাব্‌ টু ল্যাণ্ড’ প্রথায় কৃষি সম্প্রসারণের কাজ চলত এবং সেচের জন্য পুকুর সংস্কার ও খনন করে রবিশস্য ও শীতকালীন চাষে গ্রামবাসীকে উৎসাহিত করা হত। প্রথম দিকে শ্রীনিকেতনে ৫০ বিঘা চাষযোগ্য জমি ও একটি বড় পুকুর নিয়ে কৃষিকাজ চলত যা পরবর্তীতে বেড়ে ৮০ বিঘায় দাঁড়ায় (শ্রীনিকেতন ডায়েরি, রবীন্দ্রভবন লেখ্যাগার)।

১৯২৯ সালে শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন সংলগ্ন প্রায় ৭০০ একর ডাঙা জমি সরকারি অধিগ্রহণের পরে বিশ্বভারতীর আওতাভুক্ত হয়, যার ২০০ বিঘা স্থানীয় সাঁওতালদের কৃষিকাজের জন্য বিলি করা হয়। ১৯২৩ সালে শ্রীনিকেতন খামারের জন্য ৬ হাজার টাকায় একটি অস্টিন ট্রাক্টর কেনা হয়। এলম্‌হার্স্ট নিজে এই ট্রাক্টর চালাতেন। ১৯২৯ সালে ৩ হাজার টাকায় একটি ফোর্ডসন ট্রাক্টর কেনা হয়। এর আগেই ১৯২৬ সাল নাগাদ কৃষিতে জমির ঊর্বরতা ও ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সবুজ সারের সঙ্গে বিঘাপ্রতি ‘এমোফস্‌’ রাসায়নিক সারের ব্যবহার শুরু হয়। ধান, আখ, গম, আলু, তামাক, বিট, গাজর, ফুলকপি প্রভৃতি আনাজের সঙ্গে কলা, পেয়ারা, আনারস প্রভৃতি ফলের পরীক্ষামূলক চাষ হত। গোখাদ্যের জন্য নেপিয়া ও গিনি ঘাস, কলাই, জোয়ার প্রভৃতি চাষ হত এবং সাইলো প্রথায় তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হত। ১৯৩১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে শ্রীনিকেতনে কর্পূর, খয়ের, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি প্রভৃতি লাগান হয়।

সূচনা পর্বে (১৯২২ সালে) শ্রীনিকেতন কৃষিবিভাগের সঙ্গে শ্রীনিকেতন গোশালাও অন্তর্ভুক্ত ছিল — সিন্ধ্রি, জার্সি, হরিয়ানা প্রভৃতি জাতের গরু ছিল। পরবর্তীকালে মণ্টগোমারি ষাঁড় আনা হয়। ভাল গরু উৎপাদনের উদ্দেশ্যে গ্রামগুলিতে ভাল ষাঁড় দেওয়া হত। ১৯৩৩ সালে যমুনাপুরী মাদি ছাগল ও একটি মদ্দা ছাগল নিয়ে গোটারি চালু হয়।

১৯২৪ সালে শুরু হয় হাঁস ও মুরগিপালন— লেগহর্ন, রোডআইল্যাণ্ড প্রভৃতি জাতের মুরগিপালন হত। ১৯২৭ সালে কৃষির সঙ্গে মৎস চাষও যুক্ত হয়। একইভাবে মৌমাছি প্রতিপালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এইভাবে ১৯২২ সালে মাত্র কয়েকটি গরু ও বাছুর নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেন তা ক্রমে আশেপাশে বেশ কয়েকটি গ্রামে বিস্তার লাভ করে।

শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই রবীন্দ্রনাথ এলম্‌হার্স্টকে লেখেন, ‘This is why all the kind when Sriniketan has been struggling to grow into a form, I was intently that it should not only have a shape but also light, so that it might transcend its immediate limits of time, space and some special purpose. A lighted lamp is, for us the end, and not a lump of fold. (Poet and Plowman)’ পল্লিউন্নয়নের কাজে বহু শ্রম ও অর্থব্যয়ের পরেও রবীন্দ্রনাথকে অপমান, অসম্মান ও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৯৩৭ (ফাল্গুন ৩০, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ), রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭৬ বছর, সাহিত্যের এক আড্ডায় শান্তিনিকেতনী ঘরানায় সৌজন্য বজায় রেখে ‘রবিবাসরে’ উপস্থিত সদস্যদের সামনে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন— ‘আমি ধনী নই, আমার যে সাধ্য ছিল, আমার যে সম্পত্তি ছিল, যে সামান্য সম্বল ছিল, আমি এই অপমানিতের জন্য তা দিয়েছি। ... আজ আপনারা কবি রবীন্দ্রনাথকে নয়, তার কর্মের অনুষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ করুন, দেখে লিখুন, সকলকে জানিয়ে দিন কত বড়ো দুঃসাধ্য কাজের ভিতর আমাকে জড়িয়ে ফেলতে হয়েছে।’

পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতে কৃষক-কল্যাণের যে সরকারি প্রয়াস তাতে অনস্বীকার্য, রবীন্দ্রনাথের ‘শ্রীনিকেতন’ বর্তমানে ভারতে পল্লিউন্নয়ন কর্মসূচিগুলির আঁতুরঘর। তাঁর পল্লিপুনর্গঠন পরিকল্পনার মূল তিনটি মতাদর্শ— আত্মশক্তি, সমবায় ও উন্নয়নের উদ্বোধন, আজ সমগ্র ভারতে গ্রামোন্নয়নের ভিত্তি। রবীন্দ্রনাথের পল্লিউন্নয়নের ‘মডেল’ সমগ্র ভারতে প্রশংসনীয় উদ্যম ও আদর্শ হিসেবে গণ্য হলেও দুঃখের বিষয় অনুসরণীয় হলনা, তথাপি বলা যায় রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংগঠকরূপে ভারতে অন্যতম পথিকৃৎ।

(লেখক— গবেষক ও বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement