ছবি রয়টার্স
করোনাভাইরাসের নূতন ‘স্ট্রেন’ বা প্রকারভেদ লইয়া উদ্বেগের কারণ নাই, বলিয়াছে কেন্দ্র। উদ্বেগ এড়াইয়া চলা মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। কিন্তু যেখানে ভয়ের যথার্থ কারণ আছে, সেখানে নিরুদ্বেগ, প্রসন্ন চিত্তে বিচরণ করিবার চেষ্টা অর্থহীন। বিপজ্জনকও বটে। বস্তুত সেই বিপদ এড়াইবার জন্যই ব্রিটেন হইতে বিমান পরিষেবা বন্ধ করিয়াছে ভারত, আগত যাত্রীদের পরীক্ষা চলিতেছে। অতিমারির প্রতিষেধক মিলিতে দেরি নাই, এই সংবাদে বিশ্ববাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিতে না ফেলিতে ভাইরাসের নূতন স্ট্রেনের সন্ধান মিলিল। যেন হরিষে বিষাদ। তবে কি পরস্পর দূরত্ব বজায় রাখিবার, অকারণে ঘর হইতে বাহিরে না যাইবার বিধিপালন এখনও শেষ হইবে না? ইহার উত্তর, সেই সত্যের জন্য মনকে প্রস্তুত করাই এখন প্রয়োজন। বহু বিশেষজ্ঞই মনে করিতেছেন, অতিমারি-পূর্ব অবস্থাতে পুরোপুরি ফিরিয়া যাওয়া আর কখনওই হইবে না। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে টিকাদান যদি-বা সম্ভব হয়, তাহা হইলেও করোনাভাইরাস কোনও না কোনও প্রকারে থাকিয়া যাইবে, এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট। এই অনিশ্চয়তাই ‘নূতন স্বাভাবিক’। সেই ঝুঁকির বাস্তবতাকে ঘিরিয়া জীবনযাপনের ধারাকে প্রবাহিত করিতে হইবে। রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ, উভয়কেই সেই সত্য মানিতে হইবে।
আক্ষেপ, অধিকাংশ মানুষের নিকট দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা অসহনীয় বলিয়া মনে হয়। অভ্যস্ত জীবনে ফিরিবার আগ্রহ তাঁহাদের এতই তীব্র যে, কেহ ‘অলীক কল্পনা’ বলিয়া বিপদকে উড়াইয়া দেন, কেহ নিজের প্রতিরোধশক্তি সম্পর্কে নানা আজগুবি তথ্য পেশ করিয়া থাকেন। কেহ বা ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ প্রভৃতি অপরিণামদর্শী তত্ত্ব আওড়াইয়া ফুর্তি করিতে নামেন। ইহারাই পূজার পূর্বে দোকানে দোকানে সকল বিধি নস্যাৎ করিয়া জামা-জুতা কিনিয়াছিলেন, আবার ইহারাই বড়দিন ও নূতন বর্ষের মজা লুটিতে ফের রাস্তায় নামিয়াছেন। ইতিমধ্যেই পার্ক স্ট্রিটের ভিড়, পিকনিকের পরিচিত স্থানগুলিতে জনসমাগম আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। অবস্থা এমনই যে, যে কোনও উৎসব বা পার্বণ এখন জনস্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছে। অথচ, ব্রিটেনে ক্রিসমাস প্রধান উৎসব হইলেও, অতিমারির বিধিনিষেধ কিছুমাত্র লঘু করা হয় নাই। লন্ডন-সহ সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলিতে কেবল পরিবারের সহিত, ঘরের মধ্যে উৎসব পালন করা যাইবে, বাহিরে যাওয়া নিষেধ। অত্যাবশ্যক দোকানই কেবল খোলা থাকিবে। অপরাপর স্থানেও জনজীবনে মেলামেশার ক্ষেত্রে নানা স্তরের বিধিনিষেধ জারি হইয়াছে।
এত সতর্কতার কারণ, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের যথেষ্ট ভাবাইতেছে করোনাভাইরাসের নূতন প্রকার। সকল ভাইরাসের প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল, কিন্তু সকল পরিবর্তিত সংস্করণ (‘মিউটেশন’) ক্ষতিকর নহে। এই বিশেষ প্রকারটি কিন্তু ব্রিটেনের দক্ষিণে দ্রুত ছড়াইয়াছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করিতেছেন, ইহার সংক্রামক ক্ষমতা অধিক বলিয়াই এমন দ্রুত বিস্তার, আবার কেহ বলিতেছেন, কোনও কারণে ইহা দ্রুত ছড়াইবার উপযোগী পরিবেশ পাইয়াছিল। ইহার সংক্রামক ক্ষমতা নির্ধারণ করিতে এখন গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিতেছে। একই ভাবে, এই নূতন স্ট্রেন শরীরে আরও তীব্র বা জটিল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কি না, তাহা লইয়াও দ্বিমত রহিয়াছে। আপাতত স্বস্তি মিলিতে পারে কেবল এই আশ্বাসে যে, নূতন স্ট্রেনটি টিকার দ্বারা প্রতিরোধ্য নহে, এমন কোনও ইঙ্গিত মেলে নাই। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মত, নবাবিবিষ্কৃত টিকাগুলির দ্বারা এই নূতন স্ট্রেন-ও প্রতিহত হইবে। কিন্তু এমন সকল দাবিই আপাতত পরীক্ষাধীন, প্রমাণের অপেক্ষায়। অতএব সতর্কতার বিধি পালন ভিন্ন গতি নাই। উৎসব সতর্ক ভাবেই কাটুক।