অপর-বিদ্বেষ 

দক্ষিণ কলিকাতার পথে, একটি প্রথম বর্ষের মুসলিম ছাত্র গলায় একটি প্ল্যাকার্ড ঝুলাইয়া আট ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৯ ০০:৩৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

লন্ডনে এক দশ বৎসরের বালিকাকে খেলিতে লইল না এক দল কিশোর-কিশোরী, কারণ সে ‘সন্ত্রাসবাদী’। বালিকাটি শিখ, সে পাগড়ি পরিয়া ছিল, তাই তাহাকে ওই তকমা প্রদান সহজ হইল। বালিকা পরের দিন পুনরায় সেই ক্রীড়াপ্রাঙ্গণে খেলিতে যায়, একটি নয় বৎসরের বালিকার সহিত কিছু ক্ষণ খেলাও করে। কিন্তু সেই বালিকার মাতা শিখ বালিকাকে ডাকিয়া বলেন, তাহাকে দেখিতে ‘বিপজ্জনক’, সেই কারণে তিনি উহার সহিত খেলিতে দিবেন না। ইহার পর সমাজমাধ্যমে শিখ বালিকাটি অপমানের বিবরণ দিয়াছে, শোরগোল হইয়াছে। নূতন কিছু নহে। শিখ প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তা যাহা বলিয়াছেন তাহার মর্মার্থ, পাগড়ি পরিহিত শিখদের দেখিলেই যে হেতু পাশ্চাত্য সমাজ সহজে ‘অন্য’ বলিয়া চিনিতে পারে, তাই ইংল্যান্ড ও অন্য বহু দেশেই এই রূপ লাঞ্ছনা আজ শিখদের গা-সহা হইয়া গিয়াছে। পথে বাহির হইলে ‘লাদেন’ বলিয়া টিপ্পনী প্রায়ই শুনিতে হয়। খেলিবার মাঠ বড় সরল স্থান নহে, শিশু বয়স হইতেই খেলিবার সময় নানাবিধ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হইবার অভিজ্ঞতা অনেকেরই রহিয়াছে। কলিকাতার নিতান্ত সাধারণ পাড়ার মাঠেও কেহ ‘বাংলা মিডিয়াম’ বলিয়া খেলা হইতে বাদ পড়ে। কেহ গরিব বলিয়া তাহাকে নির্মম ভাবে বিতাড়ন করা হয়। শিখদের ধর্মপরিচয়টি প্রকট, ঠিক যেমন গরিবদের জাতিপরিচয় তাহাদের সর্বাঙ্গে প্রায়ই প্রতীয়মাণ। ‘ভদ্র’ পরিবারে বলিয়া দেওয়া হয়, এই সব শিশুর সহিত মিশিয়ো না। ফলে সমবয়স্কদের উতরোল ক্রীড়ার পানে জুলজুল করিয়া তাকাইয়া তাহার পর এক বার অগ্রসর হইলে, এক প্রখর ঝাপটা খাইয়া দরিদ্র শিশু বুঝিতে শিখে, এই সমাজ তাহাকে খেলায় লইবে না।

Advertisement

দক্ষিণ কলিকাতার পথে, একটি প্রথম বর্ষের মুসলিম ছাত্র গলায় একটি প্ল্যাকার্ড ঝুলাইয়া আট ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিল। প্ল্যাকার্ডে ইংরাজি ভাষায় লেখা ছিল, আমি এক পাকিস্তানি, দয়া করিয়া আমাকে চড় মারুন বা জড়াইয়া ধরুন। ইহা ছিল নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ‘নিরীক্ষা’, সাধারণ মানুষের পাক-বিদ্বেষ কত দূর। দুপুর বারোটা হইতে রাত্রি আটটা অবধি এক জনও তাহাকে প্রহার করিতে উদ্যত হন নাই, বহু মানুষ তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়াছেন। বহু মানুষ জানিতে চাহিয়াছেন সে কোনও বিপদে পড়িয়াছে কি না, অর্থসাহায্যও করিতে চাহিয়াছেন। চতুর্দিকে নানা আকার-প্রকারের বিদ্বেষের এই বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে আজ পথচলতি মানুষ ‘শত্রু’-রাষ্ট্রের এক নাগরিকের প্রতি কোনও অভদ্র ও খর ব্যবহার করিতেছেন না, ইহা এক সদর্থক চিত্র।

শিখ বালিকাটিকেও দ্বিতীয় দিনে, সেই জননী যখন খেলিতে বারণ করিতেছেন, নয় বৎসরের বালিকাটি ‘দুঃখিত’ বলিয়া গিয়াছিল। সাধারণত প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা, বিশেষত শিশুবয়সে অহেতুক রূঢ় অপ্রণয়ের ঘটনা মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে, এই বেদনা অনেকেই সমগ্র জীবনেও ভুলিতে পারে না। সেই ক্ষত হইতে হীনম্মন্যতা ও বিষাদের নানা শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হয়। আশা করা যাক, বালিকাটি জীবনে ওই কলকাতার যুবকের ন্যায়ই সুবিস্মিত হইবে, ক্রীড়াসঙ্গীর পরুষতা নহে, বরং ওই দুঃখপ্রকাশ, ওই ‘অপর’-এর বেদনা অনুভব করিবার স্নিগ্ধতাই তাহার হৃদয়ে জাগরূক থাকিবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement