বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে লক্ষ্য করিয়া ছুটিয়া আসিল পেঁয়াজ। ইহাকে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ ঘায়েল করিবার দৃষ্টান্ত বলা যাইতে পারে। জনসভায় বক্তার প্রতি টমেটো বা ডিমের পরিবর্তে পেঁয়াজ নিক্ষেপ একাধারে ক্ষোভের পরিমাণ এবং তাহার কারণ বুঝাইয়া দিল। পেঁয়াজটি নীতীশের গায়ে লাগে নাই বটে, কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিতে তাহা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নাই। ঠিক জায়গায় ঠিক বার্তাটি পৌঁছাইয়াছে। ভারতীয়েরা স্বভাবত সহনশীল, নেতাদের বহু দুর্নীতি, প্রতারণা নির্বিবাদে মানিয়া লয়। কিন্তু, অভ্যস্ত আহার না পাইলে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে। সুলভে পেঁয়াজ জুগাইতে না পারিয়া চৌধুরী চরণ সিংহ হইতে অটলবিহারী বাজপেয়ী, বহু নেতা গদি হারাইয়াছেন। এই ক্রোধ অন্যায় নহে। বাজার অর্থনীতির নিয়ম মানিয়া কোনও খাদ্যদ্রব্য কখনও সুলভ কখনও দুর্মূল্য হইবে, তাহা প্রত্যাশিত। কিন্তু, যে কয়টি দৈনন্দিন আহারে অপরিহার্য, সেগুলি সুলভে জুগাইবার দায়িত্ব রাষ্ট্র এড়াইতে পারে না। ঔপনিবেশিক সরকারের নীতির ফলে চাল দুর্মূল্য হইবার জন্য এই বাংলাতেই ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল। নাগরিকের খাদ্যের অধিকার স্বাধীন ভারতে স্বীকৃত। দুর্ভাগ্য, কেবলমাত্র চাল-গম জুগাইয়া সরকার তাহার প্রতি দায় সারিতে চাহে। ভারতের খাদ্যাভ্যাস বিচিত্র, কিন্তু আলু ও পেঁয়াজ সর্বত্র অপরিহার্য। মুখ্যমন্ত্রীকে পেঁয়াজ ছুড়িয়া, তাহাকে অত্যাবশ্যক খাদ্য বিবেচনা না করিবার সিদ্ধান্তের প্রতিও প্রশ্ন ছুড়িয়াছেন মানুষ।
পশ্চিমবঙ্গেও এ বৎসর আলু এবং পেঁয়াজ, এই দুইটি অত্যাবশ্যক সব্জির দাম অত্যধিক। জোগান কম হইলেও দামে এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত নহে, ইহা সরকারি আধিকারিকেরাও মানিতেছেন। তাঁহারা কখনও পাইকারি ব্যবসায়ী, কখনও খুচরা বিক্রেতাকে দুষিতেছেন। যেন অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের কোনও ভূমিকাই নাই। ঠগ খুঁজিতে ‘টাস্ক ফোর্স’-এর বাজারভ্রমণের প্রহসন চলিতেছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সংশোধিত কৃষি আইনকে দায়ী করিয়াছে, কারণ তাহা মজুতদারি রুখিতে রাজ্যের ক্ষমতায় রাশ টানিয়াছে। অথচ, গত বৎসর পূর্বের আইন অনুসারে মজুতদারি রুখিবার পরোয়ানা জারি করিয়াও রাজ্য পেঁয়াজের দাম কমাইতে পারে নাই। পেঁয়াজ মজুত করিবার পরিকাঠামোই বা কোথায়? বস্তুত বাজারে যথেষ্ট পেঁয়াজ নাই। রাজ্যে ‘বর্ষার পেঁয়াজ’ চাষ ঘাটতি পূরণ করিবার ধারেকাছেও আসিতে পারে নাই। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও কর্নাটকের পেঁয়াজের উপরেই নির্ভর করিতে হয়। জোগান কমিবার সঙ্গে সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘ঝোপ বুঝিয়া কোপ’ মারিবার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যায়। এ বৎসর আলু-পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার নানা উপায় রাষ্ট্রের হাতে রহিয়াছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের প্রয়োগ করিয়া মজুতদারি বন্ধ করা একটি উপায়। তৎসহ রফতানি নিয়ন্ত্রণ, অধিক আমদানি, সরকারি ক্রয় করিয়া সুলভে বিপণন, এমন নানা উপায় নানা সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য ব্যবহার করিয়াছে। এ বৎসর যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। অতিমারি-জনিত আর্থিক সঙ্কটে বহু পরিবার দারিদ্রের সীমায় আসিয়া পৌঁছাইয়াছে, আরও অগণিত পরিবার দারিদ্রে পতিত হইয়াছে। নাগরিকের দৃষ্টিতে ইহা আপৎকালীন পরিস্থিতি। সরকারকেও সেই ভাবেই তাহাকে গ্রহণ করিতে হইবে, এবং সুলভে একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি জুগাইতে হইবে। অপরের উপর দায় চাপাইয়া সমস্যার সমাধান ঘটিবে না। বরং, সমাধান সাধনে আইনের শক্তি, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক কৌশল, সকলই মিলাইতে হইবে। লক্ষ্যসিদ্ধির পরিকল্পনার পরিচয় দিতে হইবে।