পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা বস্তারের মানুষের স্বস্তির অবকাশ নেই। স্বস্তি নেই তাঁদেরও, যাঁরা এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে প্রশ্ন করেন, তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।
ধূমায়িত কফির পেয়ালা নিজের হাতে এগিয়ে দিয়ে আন্তরিক হাসি হেসে পুলিশকর্তা বলেছিলেন, ‘কোথাও অসুবিধা হয়নি তো?’ না, কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি। ছত্তীসগঢ়ের আনাচকানাচ ঘুরে মানবাধিকার কর্মী, চিকিৎসক বিনায়ক সেনের কর্মকাণ্ডের আঁচ নিচ্ছিলাম। তিনি তখন দেশদ্রোহিতা এবং মাওবাদীদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগে রায়পুর সেন্ট্রাল জেলের সলিটারি সেলে বন্দি।
ভদ্রলোক প্রায় মুখস্থের মতো আমার ঘুরে আসা যাত্রাপথের রুট জানিয়ে ফের প্রশ্ন করলেন, ‘এই যে এত জায়গায় গেলে, তোমার কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’ মাওবাদী প্রভাবিত বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা থাকায় প্রশ্নটা শুনে একটুও অবাক হইনি। বলেছিলাম, ‘আপনারা এত খেয়াল রাখেন যে মনেই হয় না বাড়িতে আছি না জঙ্গলে!’ পুলিশকর্তার নির্বিকার গলা: ‘এটুকু তো আমাদের করতেই হবে। এটা তো আমাদের কাজ!’
সেই ‘কাজ’ করতে গিয়েই নিশ্চয় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক নন্দিনী সুন্দর ও আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনেছে ছত্তীসগঢ় পুলিশ।
গত ৪ নভেম্বর বস্তারের সুকমা জেলায় শ্যামনাথ বাঘেল নামে এক গ্রামবাসীকে কুপিয়ে খুন করা হয়। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে নাকি বেশ কয়েক মাস ধরেই খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এর পরেই শ্যামনাথের স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ নন্দিনী সুন্দর, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্চনা প্রসাদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী বিনীত তিওয়ারি, ছত্তীসগঢ় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সঞ্জয় পারাত-সহ দশ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। খুন, ষড়যন্ত্র, অস্ত্র আইন, দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টার অভিযোগ তো আছেই। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)। নন্দিনী সুন্দরের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ছত্তীসগঢ় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, গ্রেফতার করা বা জেরা করার আগে তাঁদের চার সপ্তাহ সময় দিতে হবে। কিন্তু এই স্বস্তি সাময়িক!
এবং, যে ভাবে মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, গবেষক ও সাংবাদিককে ভয় দেখানো হচ্ছে, যে ভাবে পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা বস্তারের বিস্তীর্ণ অংশকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে রাখার সংগঠিত প্রয়াস চালানো হচ্ছে, তাতে বস্তারের মানুষের স্বস্তির কোনও প্রশ্নই নেই। সরকারের চোখে এই সব মানুষ সন্দেহজনক। মাওবাদীদের সমর্থক। আর কিছু লোক, মাওবাদীদের চোখে, ‘পুলিশের চর’! ‘হয় তুমি বুশকে সমর্থন কর, না হলে ধরে নেওয়া হবে তুমি লাদেনের দলে’— এই তত্ত্বেই বিশ্বাসী আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই নন্দিনী সুন্দরেরা যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগের তদন্ত করতে বস্তারের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘোরেন, সেই সব অভিযোগ তুলে এনে রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তা তো পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে স্বস্তিদায়ক হতে পারে না!
যেমন, স্বস্তিদায়ক হতে পারে না শিবরাম প্রসাদ কাল্লুরি-র কাছেও! বস্তারের এই বিতর্কিত ইনস্পেক্টর জেনারেল ছত্তীসগঢ়ের বিজেপি সরকারের খুবই প্রিয়পাত্র। মাওবাদীদের দুর্গ বলে পরিচিত এই বস্তারে তাঁকে বারে বারে আনা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থী আন্দোলনের কোমর ভেঙে দিতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকার যে ভাবে একদা রুনু গুহনিয়োগীকে তুলে ধরেছিল, বস্তারে সে ভাবেই মাওবাদী-বিরোধী মুখ হিসেবে কাল্লুরিকে তুলে ধরেছে রমন সিংহের বিজেপি সরকার।
কাল্লুরি অভিযোগ করেছেন, নন্দিনীরা মাওবাদীদের আমন্ত্রণে সুকমার গ্রামে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে ঢুকে তাদের হয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন। শ্যামনাথ মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন বলে তাঁকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়।
শ্যামনাথের খুনের পরে তাঁর স্ত্রী বিমলা যে অভিযোগ দায়ের করেন তাতে নন্দিনী সুন্দর ও অন্যান্যদের নাম ছিল বলে দাবি করেছে পুলিশ। যদিও পরে একটি টিভি চ্যানেলে তাঁর স্ত্রী জানান, এফআইআরে নন্দিনী কেন, কারও নামই তিনি বলেননি। কারণ তিনি হত্যাকারীদের চিনতে পারেননি।
গত ২ নভেম্বর বিমলা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। শ্যামনাথ মাওবাদী বিরোধী ‘টাঙ্গিয়া গোষ্ঠী’ চালাতেন বলে বাড়িতে থাকতেন না। ২ নভেম্বর তিনিও বাড়ি ফেরেন। এর দু’দিন পরেই তিনি খুন হয়ে যান। কাল্লুরিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শ্যামনাথের স্ত্রী বিমলা ১৪ কিলোমিটার দূরের থানায় অভিযোগ দায়ের করতে কী ভাবে গেলেন? গাড়িতে? না কি হেঁটে, যেটা স্বাভাবিক? কিন্তু মাত্র দু’দিন আগে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেই এতটা পথ তাঁর পক্ষে কি হাঁটা সম্ভব? সাংবাদিকের এই প্রশ্নে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাল্লুরি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
এটাও স্বাভাবিক। তাঁর রাজনৈতিক প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই কাল্লুরি কোনও বিরুদ্ধ স্বর সহ্য করবেনই বা কেন? যথার্থ বলেছেন মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘‘বস্তারে বড় আকারে সামরিকীকরণ চলছে। ওখানে প্রশাসনের একটা কালো মুখ কাল্লুরি। তিনি যা করে চলেছেন তা একেবারেই অভিপ্রেত নয়।’’
মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে দু’দফায় তাঁকে জেলে পুরেছিল ছত্তীসগঢ় সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় ‘কালা আইন’ বলে পরিচিত ছত্তীসগঢ় বিশেষ জননিরাপত্তা আইন (ছত্তীসগঢ় স্পেশাল পাবলিক সিকিউরিটি অ্যাক্ট) এবং ইউএপিএ। বিনায়ক সেন তাই বলছেন, ‘‘ওই সব এলাকায় এই ধরনের কাজ হামেশাই হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দায়ের করা, আইনি প্যাঁচে ফেলে জেলবন্দি করে রাখা— নানা ভাবে বিরুদ্ধ স্বরকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। আইনের অপপ্রয়োগ করে মানবাধিকার কর্মীদের দমন করা হচ্ছে।’’ নন্দিনী সুন্দরদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন বলে মনে করেন বিনায়ক।
এই দমন নীতি প্রয়োগ করেই দান্তেওয়াড়ায় বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় হিমাংশু কুমারের ‘বনবাসী চেতনা আশ্রম’। বেলা ভাটিয়ার মতো নৃতাত্ত্বিক শিক্ষাবিদকেও বস্তারে কাজ করতে বিস্তর বাধা দেওয়া হচ্ছে। সোনি সোরির ঘটনা তো দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছেছে।
আবার, বিনায়ক সেন এটাও বলছেন যে, ‘‘জগদলপুর লিগাল গ্রুপ খুব ভাল কাজ করছে। এত অত্যাচারের পরেও সোনি সোরি বস্তারে মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে চলেছেন। তাঁর উপরে এই অকথ্য অত্যাচার মানবতার দিক থেকে একটা বড় ‘রেসপন্স’ তৈরি করতে পেরেছে।’’ মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল-এর জাতীয় সহ-সভাপতি বিনায়ক মনে করেন, গোটা ঘটনাক্রমের পিছনে কর্পোরেট সেক্টরের বড় রকমের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। ‘‘সরকারের সঙ্গে কর্পোরেট সেক্টরের নানা গোপন ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। সে সব ‘মউ’-এর বিষয়বস্তু জানা যাচ্ছে না। সেগুলি প্রকাশ্যে আনা হোক।’’
অবশ্য নন্দিনী সুন্দরের উপর প্রশাসনের রোষের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ২০১১-য় তাঁর ও রামচন্দ্র গুহের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট ‘সালওয়া জুড়ুম’-কে বেআইনি ঘোষণা করে। সে বছর জুলাইয়ে বস্তারের টাড়মেটলা, টিমাপুরম ও মোরপল্লিতে মাওবাদীদের সন্ধানে যৌথ তল্লাশি অভিযানের সময় ৩০০টিরও বেশি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রাণহানি হয় তিন জনের, ধর্ষণ করা হয় তিন জনকে। ওই গ্রামগুলিতে পরিদর্শনের জন্য গেলে স্বামী অগ্নিবেশের উপরে কার্যত প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়। এই ঘটনাতেও সুপ্রিম কোর্টে যান নন্দিনী। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ আদালত এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুলিশ দাবি করেছিল, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর তল্লাশি চলাকালীন পালানোর সময় মাওবাদীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু গত ১৭ অক্টোবর সিবিআই আদালতে যে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর এই দাবিকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ছত্তীসগঢ় সরকারের অস্বস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে প্রকাশিত হয়েছে নন্দিনীর বহু আলোচিত দ্য বার্নিং ফরেস্ট/ইন্ডিয়া’জ ওয়ার ইন বস্তার গ্রন্থটি।
জানা নেই, বস্তারের গৃহযুদ্ধের আঁচ দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছবে কি না। সোনি সোরিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল দিল্লি থেকেই। নন্দিনীদের ভাগ্যে বিনায়ক বা সোনি সোরির মতো কিছু ঝুলছে কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে।
রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রেখে লড়াই চালানোর জন্য গণতন্ত্রের প্রকৃত মুখ হয়ে যান নন্দিনীরাই! কাল্লুরি-রা নন!