অন্ধকে অন্ধ, খঞ্জকে খঞ্জ এবং মহানায়ককে খুড়ামহাশয় বলিতে নাই— ভদ্রতার প্রাথমিক পাঠ। বিশেষত কেহ যদি মালয়ালম চলচ্চিত্রের অতিমানবিক নায়ক সম্পর্কে কথা বলেন। কিন্তু অনেকেই তাহা জানেন না, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁহারা সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ‘ট্রোল’-এর শিকার হন। সেই কুকথার তোড় ও অভিশাপের প্লাবন সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন, এবং অনতিবিলম্বে কাঁদিয়াকাটিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা ভিন্ন গতি থাকে না। সম্প্রতি এক নবাগতা অভিনেত্রীকে টিভি-সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হইয়াছিল, বিখ্যাত নায়ক মাম্মুত্তি-র বিপরীতে তাঁহাকে নায়িকা করা হইলে, আর অন্য ছবিতে মাম্মুত্তির পুত্র দুলকারের বিপরীতে নায়িকা করা হইলে, তিনি কোনটি বাছিবেন। নায়িকা উত্তর দেন, তিনি দুলকারের বিপরীতে নায়িকা হইবেন, মাম্মুত্তি বরং পিতার ভূমিকায় অভিনয় করিতে পারেন। মুহূর্তে ঝঞ্ঝা বহিয়া যায়। মাম্মুত্তির বয়স মোটে ৬৫, আর দুলকার পরিণত ৩১, তবে কী করিয়া নায়িকা ওই কথা বলেন! যিনি নায়ক, তিনি তো চিরযুবা! আর ৩১ যে কখনও কখনও ৬৫-র অধিক হইতে পারে, মন দিয়া হ য ব র ল পড়িলেই মালুম হইবে। বয়স তো ঘুরাইয়া দেওয়া যায়, তাহা না হইলে নায়ক শেষে বুড়া হইয়া মরিত! নায়কের বয়স সংখ্যা দিয়া নয়, তাঁহার আবেদন দিয়া বিচার্য। তাঁহার মুখে বলিরেখা পড়িল কি না তাহা নগণ্য প্রশ্ন, মেক-আপ দিয়া সেই বলিরেখা ঢাকা সম্ভব হইল কি না, উহাই প্রধান। নায়িকাটি বাস্তব আর রুপালি বাস্তবতাকে গুলাইয়া ফেলিয়াছেন। দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, কখনও বিপরীত। মাম্মুত্তি বাস্তবে দুলকারের পিতা হইতে পারেন, কিন্তু চলচ্চিত্রের পরদায় তিনি দুলকারের সমবয়স্ক, প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং হয়তো অধিক যৌবনবান।
এই রুপালি বাস্তবতা ঈশ্বরসদৃশ নায়কদের ক্ষেত্রে বাস্তবকে মুচড়াইয়া তাঁহাদের ইমেজের সহিত সমঞ্জস করিয়া লয়। তাই ৩১ বৎসর বয়স্ক অভিনেতা-পরিচালক-গায়ক বিনীত শ্রীনিবাসন ৫৭ বৎসরের মোহনলালকে কৃতজ্ঞতা জানাইতে দিয়া তাঁহাকে ‘আংকল’ ডাকিয়া মহাপাপ করিয়াছেন। মোহনলাল যদিও বিনীতের পিতার বন্ধু, তাঁহাকে কাকু ডাকিয়াই হয়তো তিনি বড় হইয়াছেন, তাহা বলিয়া তো সামাজিক মাধ্যমে তাঁহাকে ওই সম্বোধন করা চলে না! ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ অনুরাগীরা বলিয়াছেন, ‘দাদা’ ডাকা উচিত ছিল। এই যুক্তি অনুযায়ী হয়তো পুত্র-অভিনেতাও পিতা-অভিনেতাকে দাদা বলিয়া ডাকিবেন, কিন্তু তাহাতে তো রুপালি ব্যাকরণ শুদ্ধ হইবে! মূল স্রোতের বাণিজ্যিক ছবি দেখিতে বসিবার মূলধন হইল ‘অবিশ্বাস’কে স্বেচ্ছায় স্থগিত রাখা। তাহা কেবল কাহিনির গাভী যখন বৃক্ষশীর্ষে উঠিতেছে তখন প্রযোজ্য নহে, নায়কের প্রকৃত বয়সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রেক্ষাগৃহের বাহিরে যে জগৎ বহিয়া যাইতেছে, সেইখানে শ্বাস লইবার সময়েও সেই ঘোরকে বহিয়া চলিতে হয়। তাই ভারতীয় ছবির প্রকৃত রসগ্রাহী হইতে গেলে ‘যুক্তি মুলতুবি’র গভীর অনুশীলন প্রয়োজন। তাহা হইলে বুঝিতে অসুবিধা হইবে না যে মহানায়কেরা ছবিতে যেমন সর্বপারদর্শী ও চিরসুন্দর, বাস্তবেও তাহাই। যদি কেহ কর্কশ বুদ্ধি দিয়া সেই বিশ্বাস ভাঙিতে চাহে, তবে সে গালিযোগ্য, কারণ সত্য লইয়া হইহই অনেক হইয়াছে, ইহা স্বপ্নবিলাসের দেশ, ইহা সত্যোত্তর (পোস্ট-ট্রুথ) যুগ।