প্রিয় স্যর রবীন্দ্রনাথ, আপনি লন্ডনে এসেছেন শুনে থেকেই আমি আপনাকে চিঠি লেখার সাহস খুঁজছি।... হয়তো এই চিঠি কোনও দিন আপনার কাছে পৌঁছবে না।... প্রায় দু’বছর হয়ে গেল, আমার প্রিয় বড় ছেলে শেষ বারের মতো যুদ্ধে যায়। সেই দিন সে আমাকে বিদায় জানিয়েছিল। আমরা একসঙ্গে সূর্যের আলোয় ঝলমলে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলাম; ভাঙা হৃদয়ে চেয়েছিলাম ফ্রান্সের দিকে। আর তখনই আমার কবিপুত্র আপনার এই অসাধারণ শব্দগুলি আমাকে শোনায়: ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই/ যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’”
— এই চিঠি রবীন্দ্রনাথকে ১৯২০ সালে লিখেছিলেন সুজ়ান আওয়েন। পৃথিবীর অন্যতম সেরা যুদ্ধবিরোধী কবি, পঁচিশ বছরের তরুণ সৈনিক উইলফ্রেড আওয়েন গীতাঞ্জলি-র ছিয়ানব্বই নম্বর কবিতার এই পঙ্ক্তি দু’টি সুজ়ান অর্থাৎ তাঁর মাকে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন শেষ যাওয়ার সময়৷ হয়তো কবি বুঝেছিলেন, তিনি আর ফিরবেন না। হয়তো বা এ ছিল তাঁর খুব চেনা যুদ্ধের অভিজ্ঞতাজাত এক স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তবু আশ্চর্য এইখানে, যে সৈনিক কবি তাঁর প্রিয়তম মানুষটির কাছ থেকে দূরে যাওয়ার সময় নিজের লেখা কবিতার পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেননি। তিনি তাঁর বলার কথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন প্রাচ্যের এক অন্য ভাষার কবির কলম থেকে। আজ আওয়েনের অকালমৃত্যুর একশো বছরে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের দেশের মানুষ হিসাবে আমাদের বাড়তি দায় তো থাকেই তাঁকে স্মরণ করার। আওয়েন যেমন রবীন্দ্রনাথে বাঁধা পড়েছিলেন এক অচেনা সুতোয়, আমাদের যাপন ও বিশ্ব পরিস্থিতিও যেন তেমনই এক অমোঘ টানে ছুটে যায় তাঁর কবিতার দিকে।
উইলফ্রেড আওয়েন (১৮৯৩-১৯১৮) কবি জীবনের শুরুতে ছিলেন বাইবেল-অনুসারী এক রোমান্টিক মানুষ। শেলি, কিটসের পরম অনুরাগী। ১৯১৩ সালে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা পড়াবেন বলে যুক্ত হন ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে থাকাকালীন শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আওয়েন দেশে ফিরলেন৷ অচিরেই শুরু হল কবির সৈনিক জীবন। সাত মাস ট্রেনিং নিয়ে নিযুক্ত হলেন ম্যাঞ্চেস্টার রেজিমেন্ট-এ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে। প্রথম দিকে সৈনিকজীবন বর্ণহীন লাগত। সাথিদের মনে হত অভিব্যক্তিহীন অস্তিত্ব। দ্বিতীয় পর্বে তিনি শেলের গর্তে পড়ে মারাত্মক আহত হলেন মর্টারে। সঙ্গীহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন অনেকটা সময়। ‘শেল শক’ আওয়েনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। এডিনবরায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ পরিবৃত অবস্থায়। যুদ্ধ জীবনকে যে কী সাংঘাতিক ভাবে অনিশ্চিত ও মেকি করে ফেলছে, তা এই প্রথম হৃদয় দিয়ে বুঝলেন তরুণ কবি। এডিনবরাতেই যুদ্ধবিরোধী কবি সিগফ্রয়েড স্যাসুন-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হল। এই দুই কবির বন্ধুত্ব এক অসামান্য উচ্চতায় উঠেছিল। আওয়েনের কবিতার ধরন ক্রমশ বদলাচ্ছিল। কিছুটা পরিস্থিতির প্রভাবে, কিছুটা মায়ের সঙ্গে আত্মিক যোগে, অনেকটা স্যাসুনের ছাপেও।
স্যাসুনের তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে না জানিয়ে আওয়েন ফিরে গেলেন ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে। কারণ আওয়েন ছিলেন যুদ্ধের আসল বর্বরতা বুঝে ফেলা এক মোহমুক্ত অথচ সাহসী যোদ্ধা। এই সাহস অনেক যুদ্ধেই জার্মানদের বিরুদ্ধে তাঁকে জয় এনে দিল। তিনি জানতে পারলেন, তাঁকে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হবে। সত্যিই হয়েছিল, তবে তার আগেই, ৪ নভেম্বর নিহত হন পঁচিশ বছর বয়সি উইলফ্রেড আওয়েন। আর এক সপ্তাহ বাঁচলেই এসে যেত ‘শান্তি ঘোষণা’র দিন। সেই দিনই ছেলের বদলে ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেলেন সুজ়ান আওয়েন। স্মৃতি ফলকে কী লেখা হবে, ছেলের কবিতা থেকে বেছে দিলেন মা স্বয়ং। সেখানে জেগে রইল সেই চিরন্তন প্রশ্ন: জীবন কি এই দেহগুলিতে আর কখনও ফিরে আসবে?
স্বরচিত মাত্র পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হতে দেখে গিয়েছিলেন আওয়েন। বাকি পাণ্ডুলিপি ছাপা হয় ১৯২০ থেকে ১৯৮৩, ছয় দশক ধরে। আওয়েনের কবিতাকে ধরতে গেলে পৌঁছে যেতে হবে ‘সেন্ড অফ’-এর সেই গলিপথে, যেখানে অঙ্গহীন সৈন্যের বিধ্বস্ত ঘরে ফেরার নৈঃশব্দ্য ছাপিয়ে যাচ্ছে রণডঙ্কা, রণহুঙ্কারকে। আমরা লজ্জায়, ভয়ে শিউরে উঠি যখন ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’-এ এক নিহত সৈন্য তার হন্তাকে বলে, ‘‘বন্ধু, আমি তোমার সেই শত্রু, যাকে তুমি হত্যা করেছ।” আসলে যুদ্ধে সৈন্য যত জনকেই হত্যা করুক, রক্ত তো তার নিজেরই ঝরে? আর সেই হত্যালীলা, সেই ধোঁয়া ধুলো আর্তনাদ জয়পরাজয়ের হিসাবনিকাশ শেষ হলে পড়ে থাকে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা, এবং এক শাস্তি— জীবন, যৌবনকে আঘাত করার পাপের শাস্তি। আওয়েন মোমবাতির আলো চলকাতে দেখেন “ছেলেদের হাতে নয়, তাদের চোখে।”
যে বই আওয়েনের প্রকাশ করে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তার ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমার বিষয় হল যুদ্ধ। যুদ্ধের যন্ত্রণা।” একশো বছর হয়ে গেল, উইলফ্রেড আওয়েন চলে গিয়েছেন। গত ৪ নভেম্বর গানে, কবিতায়, বক্তৃতায় সারা দিন ধরে তাঁকে স্মরণ করলেন ‘উইলফ্রেড আওয়েন অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্যরা, তাঁর আত্মীয়রা। টাওয়ার অব লন্ডন-এর চার পাশে সেই রাতে কবির স্মরণে জ্বলে উঠল দশ হাজার মোমবাতি। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে পোয়েটস কর্নার-এ তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হল। বছরভর চলতে থাকবে যুদ্ধবিরোধী কবিকে স্মরণ করে এমন নানা অনুষ্ঠান।
এবং বছরভর বোমা পড়বে স্কুলবাড়ি থেকে হাসপাতাল সর্বত্র। হাল্লা রাজার সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে এখনও অনেক আওয়েন চাই।