ত্রয়ী: তিন উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টো, ইসমত চুঘতাই ও রশিদ জাহান, দুঃসাহসী ও বিতর্কিত লেখার জন্যই যাঁদের খ্যাতি
নন্দিতা দাস-এর ‘মান্টো’ ছবিটি দেখার পর ইসমত বেহেন-মান্টো সাহিব-এর বন্ধুত্ব নিয়ে দু’একটা লেখা চোখে পড়ছে। সেই সূত্রে মনের মধ্যে বার বার ভেসে উঠছে মান্টোর চেয়ে বছর সাতেকের বড় আর এক আশ্চর্য উর্দু লেখিকার মুখ— অনায়াসে যিনি হতে পারতেন মান্টোর বড়দি! সাহিত্যজগতে তো বটেই, পারিবারিক ভাবেও। কারণ দু’জনের পরিবারই ছিল আদতে কাশ্মীরি! মস্কো শহরে ভারতের সেই লেখিকার কবর আছে, জানেন?
লেখিকাকে আমি প্রথম খুঁজে পাই ১৯৯০ সাল নাগাদ নিসিম ইজ়িকেল ও মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘অ্যানাদার ইন্ডিয়া’ নামে একটি বইয়ে। ভারতের বিভিন্ন ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত গল্প ও কবিতার একটি ছিমছাম সঙ্কলন। সেই বইয়ে একটি চমক-লাগানো উর্দু গল্পের স্রষ্টার পরিচয় প্রসঙ্গে লেখা ছিল যে তিনি পেশায় ডাক্তার এবং ১৯৩০-৪০’এর দশকে মেরঠ, বুলন্দশহর প্রভৃতি জায়গায় ডাক্তারি করে বেরিয়েছেন। ১৯৫২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সমাধি-লিপিতে নাকি লেখা হয় ‘আ কমিউনিস্ট ডক্টর অ্যান্ড রাইটার’।
এ সব পড়ে তাক লেগে গেলেও আমি তার পর বহু দিন ওই লেখিকার কোনও বইয়ের সন্ধান পাইনি বা তাঁর বিষয়ে তেমন কিছু জানতেও পারিনি! হঠাৎই বছর-তিনেক আগে ইসমত চুঘতাই-এর শতবর্ষ উপলক্ষে একটা লেখা তৈরি করতে গিয়ে আবার দেখা পেলাম সেই পলাতকা-র। নাম রশিদ জাহান (১৯০৫-৫২)। হাতে এল রশিদকে নিয়ে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি জীবনী ও রচনা সংগ্রহ, রাক্সান্দা জলিল-এর সম্পাদনায়।
ইসমতের আত্মজীবনী ফিরে পড়তে গিয়ে দেখলাম যাঁকে নিজের ‘মেন্টর’ বলে উল্লেখ করেছেন এই উপমহাদেশের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ লেখিকা, ইনিই তিনি! আর ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় ১৯৩৫-৪০’এ অমৃতসরে বসবাসকালে যে লেখিকা ও তাঁর অধ্যাপক-স্বামীর দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হন ও যাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে পঞ্জাবের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন, তিনিই ইসমতের মেন্টর-দিদি। সদ্য বিএ পাশ-করা ইসমতের সঙ্গে ১৯৩৬ সালে লখনউয়ে প্রথম প্রগতিশীল লেখক সম্মেলনে আলাপ হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতা-সংগঠকদের মধ্যমণি রশিদের।
এই লেখক-ডাক্তারটিকে আরও একটা নামে ডাকা হত ত্রিশের দশকে। রশিদ জাহান আঙ্গারেওয়ালি। ১৯৩২ সালে ‘অঙ্গারে’ নামক উর্দু গল্পের যে দুঃসাহসী সঙ্কলনটি বাজারে বেরোনোর অল্প কিছু দিনের মধ্যে যুক্ত প্রদেশে নিষিদ্ধ করা হয়, তার চার জন গল্পকারের মধ্যে এক জন ওই লেখক-দিদি। বাকিরা হলেন সাজ্জাদ জ়াহির, আহমেদ আলি ও রশিদের জীবনসঙ্গী মাহমুদ-উজ়-জ়াফর। সাহিত্যে বিধিনিষেধ এবং উত্তর ভারতের মুসলমান সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির মূলে এঁরা চার জনই নিঃসন্দেহে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। তাই আওয়াজ উঠল এ বইটা ‘নোংরা’, ‘ভাষা ও ভঙ্গিতে নির্লজ্জ’, এবং ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আক্রমণাত্মক’! ‘অঙ্গারে’ বিতর্ককে ঘিরে পাল্টা-আওয়াজ তুললেন নানা ভাষার প্রগতিশীল লেখকরা; ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। তিন বছরের মধ্যেই হয়ে গেল প্রথম প্রগতিশীল লেখক সম্মেলন।
তাঁদের ছোট গল্প ‘ঠান্ডা গোস্ত’ ও ‘লিহাফ’-এর জন্য মান্টো আর ইসমতকে অশ্লীলতার দায়ে কী ভাবে আদালতে হয়রানি হতে হয়েছিল, আমরা জানি। তারও বছরদশেক আগে ‘অঙ্গারে’ বেরোনোর পর রশিদ জাহানের দু’টি ছোট গল্প ‘দিল্লি কি শেহর’ ও ‘পর্দে কি পিছে’-র জন্য তাঁর নাক কেটে নেওয়ার ফতোয়া জারি করে মৌলবাদীরা। তাঁর গল্পের চরিত্রদের বিয়ের মধ্যে ধর্ষণ এবং স্বামী সংসর্গে যৌন রোগ হওয়ায়, অ্যাসিড আক্রমণেরও হুমকি আসে! রশিদকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন বডিগার্ড নিয়ে ডাক্তারি করতে বেরোতে! কিন্তু ‘কুছ পরোয়া নহি’ ভঙ্গিতে আমাদের এই লেখক-ডাক্তারদিদি খুব কম পয়সায় বা বিনামূল্যে চিকিৎসা করেছেন মানুষের। শৈশবে যিনি পর্দা-ঢাকা পালকিতে চেপে আলিগড়ে তাঁর বাবা-মায়ের তৈরি স্কুলে পড়তে যেতেন, পরবর্তী কালে তিনিই ছোট গল্প ও নাটকে শরিফ পরিবারের মেয়েদের শরীর, যৌনতা, বিয়ের মধ্যে যৌনদাসত্বের মতো বিষয় আনেন। তাঁর অধ্যাপক-স্বামী সর্ব অর্থেই ছিলেন রশিদের সহব্রতী।
রশিদ জাহান আঙ্গারেওয়ালি উর্দু সাহিত্যে এ রকম সব অস্পৃশ্য ও বিধর্মী বিষয় আমদানি করেছিলেন বলেই বোধ হয়, ইসমত চুঘতাই নিজের জীবনচর্যায় ও লেখায় রশিদা-আপার প্রভাব সম্পর্কে লেখেন: ‘‘আমি মুক্তো গেঁথে তোলার মতো করে তাঁর লেখা মণিকোঠায় রেখে দিয়েছি… রশিদ জাহান গজদন্ত মূর্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দেন… জীবন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ নিরাভরণ বেশে!’’ রশিদের চুলের ছাঁট, সোজাসাপ্টা প্রকাশভঙ্গি, গভীর আত্মমর্যাদাবোধ ও চেকভ-প্রীতি— সবই সঞ্চারিত হয়েছিল ইসমতের মধ্যে।
‘মান্টো’ ছবিতে ইসমত-মান্টোর বন্ধুত্ব বড় জায়গা পেয়েছে। পাওয়ারই কথা। মান্টোর মুম্বইয়ের দিনগুলো থেকেই এ ছবির শুরু, যখন দু’জনে একত্রে কাজ করেছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য, দু’জনের আড্ডা-তর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে এক অনুপম বন্ধুত্ব! কিন্তু আমি ভাবছিলাম আর একটা কথা।
লুধিয়ানা ও অমৃতসরে শৈশব-যৌবন কেটেছে মান্টোর। যে বছর মান্টো আলিগড়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে, সে বছর অর্থাৎ ১৯৩৪-এই রশিদ জাহান আঙ্গারেওয়ালি অমৃতসরে বাসা বাঁধেন তিন বছরের জন্য। ও দিকে আবার আলিগড়ে যাওয়ার পরে পরেই মান্টো জড়িয়ে পড়েন প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের কাজকর্মের সঙ্গে, যে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠালগ্নের সংগঠক ছিলেন আলিগড়ের মেয়ে রশিদ। তাই মান্টোর সঙ্গে রশিদা-আপার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর, কিন্তু কখনও দেখা হয়েছিল কি না জানা নেই। আসলে রশিদাকে নিয়ে বহু দিনই কেউ মাথা ঘামাননি, উর্দু সাহিত্য জগতের কিছু মানুষ ছাড়া। আর আমরা তো সাধারণত ধরেই নিই যে মেয়েরা বড়জোর নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান চালাবে, লেখক-রাজনৈতিক কর্মী নারী যে লিঙ্গনির্বিশেষে সমমনস্ক চিন্তাশীল মানুষের কাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তার স্বীকৃতি কতটুকু আমাদের চিন্তাচেতনার ইতিহাসে?
এ বছর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ৭৫ বছরে পা দিল। দুই বছর আগে প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের ৮০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। নানাবিধ স্মরণে নতুন করে খোঁজ পড়ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জরুরি একটা পর্বের। পুরনো কাসুন্দি নতুন করে ঘাঁটার সময়ে রশিদের মতো স্থপতি আর মেন্টর-দিদিদের দিকেও না হয় একটু নরম আলো পড়ুক। সেই সঙ্গে মৌলবাদী উত্থান ও লেখক-শিল্পী-ইতিহাসবিদদের বাক্স্বাধীনতা হরণের নবতম পর্বে ১৯৩৩-এর ‘অঙ্গারে’ বিতর্ক ও লেখক-গোষ্ঠীর প্রত্যুত্তরও ফিরে পড়া যেতে পারে।