নোভাক জোকোভিচ
যুদ্ধবিধ্বস্ত, বহু খণ্ডে বিভক্ত দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আইকন তিনি। ন’বার ফাইনালে উঠে ন’বারই অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতলেন টেনিসের ‘জোকার’, নোভাক জোকোভিচ
সময়টা খুব এলোমেলো। ১৯৯০-এর আগে-পরে। প্রথমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট, তার পর বড় দেশটার টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। বিবিধ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, স্বাধীনতার যুদ্ধ, অভ্যুত্থান, এবং শেষাবধি একটা নিষ্ফলা দশক। এই যুগোস্লাভ যুদ্ধ, যেখান থেকে যুগোস্লাভিয়া দেশটা ভাঙতে ভাঙতে সাতটা দেশের জন্ম, সেই আমলের প্রাক্কালেই জন্ম নোভাক জোকোভিচের। সেই সাতটির একটি সার্বিয়া, যার নাম এখন জোকোভিচের সূত্রেই জগৎসভায় বার বার উচ্চারিত হয়।
পূর্ব ইউরোপব্যাপী বিপ্লবে সমাজতন্ত্রে ধস নামার ঠিক দু’বছর আগে জোকোভিচের জন্ম। সামান্য উপকরণের সেই দুনিয়ায় প্রিয় খেলনা ছিল মিনি-র্যাকেট আর নরম ফোমের বল, তাঁর বাবার কথায় ‘জীবনের প্রিয়তম খেলনা’। বাকি গল্পটা রূপকথার মতো। ক্বচিৎ ছেলেবেলায় আস্ত ভবিষ্যতের স্ফুরণ দেখা যায়, বাবা-মায়ের জ্ঞান না থাকলে তো আরওই নয়। যদিও জোকোভিচ দম্পতির ছিল দূরদৃষ্টি, চার বছর বয়সি পুত্রকে অন্য শহরের এক টেনিস শিবিরে পাঠিয়ে দেন। আর দু’বছর বাদে, প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ারও আগে, বেলগ্রেডের টেনিস ক্লাব ‘তেনিস্কি ক্লুব পার্তিজান’-এ ভর্তি হয় নোভাক। মাউন্ট কাপায়োনিকে ফাস্ট ফুড পার্লার আর ক্রীড়াসরঞ্জামের ব্যবসা করতেন জোকোভিচ দম্পতি। সেখানেই যুগোস্লাভ-সার্ব টেনিস কোচ ইয়েলেনা গেনচিচ-এর প্রশিক্ষণে প্রস্তুত হতে থাকে তাঁদের পুত্র। ছ’বছর খেলা শেখানোর পর গেনচিচ বোঝেন, এত দ্রুত যার উন্নতি, সে যে-সে খেলোয়াড় হতে পারে না, বিদেশের প্রতিযোগিতায় নামানো দরকার। যোগাযোগ করিয়ে দেন যুগোস্লাভ-ক্রোট তারকা নিকোলা পিলিচ-এর সঙ্গে, জার্মানির ওবারশ্লাইসহেম-এর পিলিচ টেনিস অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ হয় চার বছর। ১৪ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক মঞ্চ, সিঙ্গলস-ডাবলস-দলগত খেলায় ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। ২০০৬ থেকে স্লোভাক কোচ মারিয়ান ভাইদা-র তত্ত্বাবধানে উত্তুঙ্গে আরোহণ। ২০১৩-য় প্রশিক্ষক হিসেবে কিংবদন্তি বরিস বেকার-কে পান, তত দিনে জোকোভিচ নিজেও কিংবদন্তি হওয়ার পথে।
এখন বছরভর কোনও না কোনও রেকর্ড করে চলেন জোকোভিচ, অতএব হইচইও। সাম্প্রতিক উত্তেজনার হেতু— গত ২১ ফেব্রুয়ারি নবম বারের জন্য অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতলেন তিনি। নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙলেন— ন’বার ফাইনাল, ন’বারই চ্যাম্পিয়ন। সব গ্র্যান্ড স্ল্যাম মিলিয়ে ১৮। অর্থাৎ অন্য দুই সেরা, রজার ফেডেরার আর রাফায়েল নাদালের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা। এ দিনের ম্যাচে এক বার একটানা ১৩টা গেমের মধ্যে ১১টা দখল করেন জোকোভিচ, দৃশ্যত হতাশ হয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ দানিল মেদভেদেভ; ৭-৫, ৬-২, ৬-২ স্কোরে খেলা বার করে নিয়ে যান নোভাক।
ফেডেরার-নাদাল-জোকোভিচ এখন পুরুষ টেনিসের ‘গ্রেট থ্রি’। অন্য দুই যখন প্রায়-প্রতিষ্ঠিত, তখন মঞ্চে প্রবেশ জোকোভিচের, দুইয়ের কারও না কারও টানা বড় টুর্নামেন্ট জিতে চলার রেকর্ড ভেঙে ২০০৮ অস্ট্রেলীয় ওপেন তুলে নেওয়া। তিন বছরের মধ্যে বিশ্বশীর্ষে, আগামী এক দশক বার বারই এক/দুই/তিন নম্বরে বছর শেষ করা। পর পর চারটে বড় খেতাব দখল করার বিরল কৃতিত্বও অর্জন করেন, বিশ্বে হাতে গোনা কয়েক জনেরই যা রয়েছে। তিনটে আলাদা কোর্টে এই কৃতিত্ব তো আরও বিরল। ফেডেরার-নাদালের অনেক পিছনে শুরু করেও কোথাও তাঁদের টপকে গিয়েছেন জোকোভিচ।
ঘাসের কোর্টে জিতবেন ফেডেরার, মাটির কোর্টে নাদাল, হার্ড কোর্টে জোকোভিচ— আপাতত এই কি টেনিসের ভবিতব্য? আর হলেই বা ক্ষতি কি? ডমিনিক টিম, আলেকজ়ান্ডর জ়েরেভ, স্টেফানোস চিচিপাস-রা ভালই খেলছেন, শুধু ভাল নয় চমৎকার, দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন, ভাল টেনিস দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন খেলাপ্রেমীদের। শুধু জিততে পারছেন না। হয়তো তাঁরা একটু ভুল সময়ে এ অঙ্গনে অবতীর্ণ হয়েছেন। তেত্রিশের জোকোভিচ যে এখনও বলেন, “বয়স সংখ্যামাত্র, টেনিস খেলতে আমার ক্লান্ত লাগে না, মনে হয় আমার মধ্যে আরও সম্ভাবনা আছে।” এবং, প্রমাণও করেন।
জোকোভিচ চরিত্র এমনই ব্যতিক্রমী। বস্তুত, বিশ্বমঞ্চে খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের আগেই তাঁর অনুকরণ বা ‘মিমিক্রি’র খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৭ আমেরিকান ওপেনের লকার রুম মাতিয়ে দিয়েছিলেন তাবড় তারকাদের নকল করে। মারিয়া শারাপোভার চিৎকার বা নাদালের পোশাক ঠিক করার ভঙ্গি নকল করে আখ্যা পেয়েছিলেন ‘জোকার’, আজ অবশ্য বয়স ও রেকর্ডের আড়ালে সেই ডাকনাম মলিন।
খুদে নোভাককে দেখে গেনচিচ বলেছিলেন, “মোনিকা সেলেস-এর পর এত বড় প্রতিভা আমি আর দেখিনি।” যুদ্ধজর্জরিত দেশ ছেড়ে আমেরিকা গিয়ে নতুন করে কেরিয়ার সাজাতে বাধ্য হয়েছিলেন সেলেস। জোকোভিচ থেকে গিয়েছেন। সার্বিয়া তার পরেও ভেঙেছে, ভাঙছে; সংঘাত চলমান। শুধু খেলে চলেছেন নোভাক। চলবেনও।