উত্তর-পূর্ব ভারতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফাইল ছবি
বড়োরা অসমের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। বড়ো জনজাতিরা মূলত কাছাড়ের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে আছে, রাভাস, কচ মেচ, গাড়ো, সনোআল, লালুং, দেউরি, দিমাসা, সোরানিয়া, বর্মণ, হোজাই, হাজাং, চুতিয়া, ত্রিপুরি এবং মরান। এই সব কছাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষাকে ‘বড়ো’ ভাষা বলা হয় এবং এই সব জনজাতিকে এক কথায় ‘বড়ো’ বলা হয়ে থাকে।
বড়ো আন্দোলন অসমের জাতিগত আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো। এক সময়ে বড়োরা ছিল সমৃদ্ধ এবং সংস্কৃতিমনস্ক। তাঁদের ভাষাও ছিল যথেষ্ট উন্নত। ফলে, তাঁদের এক নির্দিষ্ট পরিচয় ছিল। দিমাপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল এক সমৃদ্ধশালী নগরী। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে লাগাতার আক্রমণে তাঁরা উত্তর কাছাড় প্রদেশে মাইকিং এবং পরে কাছাড় প্রদেশে ঘাসপুরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে কছাড়িদের ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকায় দু’টি রাজ্য তৈরি করার কথা জানা যায়। শনিতপুরে বানার এবং নরকাসুরের প্রাগজ্যোতিষপুর।
বড়োদের অভিযোগ, এখন তাঁরা অসমীয়া জাতির দ্বারা শোষিত এবং বৈষম্যের শিকার। বড়োদের মতে, তাঁরাই অসমের ভূমিপুত্র। সুতরাং, তাঁরা আলাদা রাজ্যের অধিকারী। বড়োরা অসম জুড়ে ছড়িয়ে আছেন। তবে তাঁদের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়, সানকশ নদীর ধারে কোকড়াঝাড়, ধুবড়ি জেলায় এবং দারাং জেলার ওরাং অঞ্চলে। মানে, কোকড়াঝাড়, বঙ্গাইগাঁও, বরপেটা, নলবাড়ি, কামরূপ এবং দারাং-এ। মোট ২৩টি ব্লকের ২,৪৯৪টি গ্রামের মধ্যে ৩০০টির বেশি গ্রামে ১০০ শতাংশ বাসিন্দা বড়ো। এবং ৮২১টি গ্রামের ৫০ শতাংশের বেশি বড়োদের বাস।
বড়োদের টিএস (ট্রাইবাল সঙ্ঘ) কংগ্রেসের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তাদের কোনও দাবি পূরণ না হওয়ায় গঠিত হোল ‘প্লেনস ট্রাইবাল কাউন্সিল অব অসম’ (পিটিসিএ)। তাঁরা চাইল স্বায়ত্তশাসিত এক আলাদা রাজ্য ‘বড়োল্যান্ড’। ১৩ জানুয়ারি ১৯৬৭ ইন্দিরা গাঁধী চাইলেন অসমকে ভেঙে আলাদা বড়ো রাজ্য গঠন করার। অসম কংগ্রেস কমিটি (ইন্দিরা) সভাপতি ললিত দোলে (মিশিং জনগোষ্ঠীর নেতা) ১৯৭৩ সালে উদয়াচল রাজ্য গঠনে তৎপর হলেন এবং দেবনাগরী লিপিকে গ্রহণ করা হল।
এর পরে পিটিসিএ দু’ভাগে ভেঙে গিয়ে পিটিসিএ এবং পিটিসিএ (প্রগ্রেসিভ) তৈরি হল। এক দল চাইল পরিপূর্ণ রাজ্য আর এক দল চাইল অসমের ভিতর থেকে স্বায়ত্তশাসন। অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ধাঁচে তৈরি হল ‘অল বড়ো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ (এবিএসইউ)। জন্ম নিল বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। শুরু হল হত্যা এবং রাজনৈতিক উথাল-পাতাল। ১৯৮৮ সালে ‘বড়ো পিপলস অ্যাকশন কমিটি’ (বিপিএসি) জন্ম নিল। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক ছড়ানো।
১৯৯১-এর জনগণনা অনুযায়ী অসমের মোট জনসংখ্যা ছিল ২,২২,৯৪,৫৬৫। সেখানে বড়োল্যান্ড গঠন করার জন্য তাঁরা চাইল অসমের ১০টি জেলা— ধুবড়ি, কোকড়াঝাড়, বঙ্গাইগাঁও, বরপেটা, নলবাড়ি, কামরূপ, দারাং, শোনিতপুর, লখিমপুর এবং ধেমাজি। যার মিলিত জনসংখ্যা হচ্ছে ১,১২,৩৮,৯৫৬। দফায় দফায় রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলতে থাকল। ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ সালে ‘বড়ো অ্যাকর্ড’ সম্পাদিত হল। ৭ মার্চ ১৯৯৩ বড়োল্যান্ড অটোনমাস কাউন্সিল (বিএসি) গঠন করার কিছু দিনের মধ্যে, ৫ অক্টোবর ১৯৯৩ বড়ো বহির্ভূত সব জাতির উপরে অত্যাচার শুরু হল। এক দিনে ১৯ জন নিহত হল। ৩০ হাজার তথাকথিত বহিরাগতকে আশ্রয় নিতে হল ক্যাম্পে। ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৩, অসম সরকার বিএসি-র পরিসর নির্ধারণ করে দিল। এর ভিতরে থাকল ২,৭৫০টি গ্রাম অর্থাৎ ৫,১৮৬ বর্গকিলোমিটার। দেখা গেল ২১,৩৭,৪৪৫ জন অধিবাসীর মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ হল সমভূমির জনজাতি। ২,৫৭ টি গ্রামের মধ্যে শুধু ১,১১০টি গ্রামে বড়ো জনজাতির প্রাধান্য ছিল। ৬২ শতাংশ বড়ো জাতিভুক্ত না হওয়ায় অশান্তি শেষ হল না। এ দিকে এবিএসইউ আরও ৫১৫টি গ্রাম এবং ‘উদয়াচল’ (ইউটি) তৈরির চাপ সৃষ্টি করতে থাকল। বিএসি-র নির্ধারিত ১৮ লক্ষ অধিবাসী অঞ্চলে দেখা গেল ১২ লক্ষ কচ-রাজবংশী। যাদের প্রধান চাহিদা ছিল তাদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়া হোক। ৫ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে প্রথম বিএসি-র বিল পাশ করা হল। ১৪ মে ১৯৯৩, গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার সঙ্গে পিএস ব্রহ্ম এবং বিষ্ণুমূর্তি আরির মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে গেল। সরকারের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৮ মে-জুনে ২০টির বেশি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং ৫,৪০০ জন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। ৫২ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হন। নিরুপায় হয়ে ভারতীয় সেনা জুলাই-এ ‘অপারেশন ক্রান্তি’ শুরু করে।
শান্তি অধরা রয়ে গেল। ১৯৯৬ সালে বড়ো-সাঁওতাল সংঘাত শুরু হল যা কোকড়াঝাড় থেকে ধুবড়ি জেলা পর্যন্ত প্রায় ২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার ছড়িয়ে পড়ল। দু’লক্ষ লোক ঘরছাড়া হল। ৭৫টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হল। মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল। আর ৭,০০০ সাঁওতাল পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এলেন। বড়ো লিবারেশন টাইগার ফ্রন্ট ব্রহ্মপুত্র মেলে এবং কোকড়াঝাড় এর শেসাপানি স্টেশনে বিস্ফোরণ ঘটাল। শুধু ১৯৯৬ সালেই ২৬০ জনের প্রানহানির খবর পাওয়া যায়।
চলতে থাকল ধ্বংসলীলা। জর্জ ফার্নান্ডেজের নেতৃতে ১৯৯৮ সালের মার্চে আবার আলোচনায় বসা হল। এই সময় আইনজীবী সুরজিৎ মিত্র বড়ো নিষিদ্ধ পার্টি এবং সরকারের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের কাজ করতেন এবং বহু ধৃত বড়োদের জামিন পেতে সাহায্য করেছিলেন। ১৩ জুন ১৯৯৮ সালে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বড়ো টেরিটোরিয়াল কাউন্সিলকে ৬ নম্বর ধারায় আনার জন্য চাপ সৃষ্টি হতে লাগল। যেটা মুখ্যত তৈরি হয়েছিল পাহাড়ি জনজাতিদের জন্য। সমভূমির জনজাতির জন্য নয়। বড়োদের জনজাতি বলে ঘোষণা করার আওয়াজ তোলা হল। ১৪ দফা বৈঠকেও মীমাংসা হল না। তার পরে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি তৃতীয় বড়ো চুক্তি সই হল। এ বার শান্তি ফিরবে কি?
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিধানচন্দ্র কলেজ, আসানসোল