জার্মানিও তখন ভাবতে পারেনি

জার্মানির সংসদভবনে আগুন কে লাগিয়েছিল, তার নিশ্চিত উত্তর আজও মেলেনি। কিন্তু সেই রাত্রেই ওই বহ্নিমান রাইখস্ট্যাগের একটি ব্যালকনিতে দাঁড়ানো, এক মাস আগে চান্সেলরের আসনে বসা হিটলারের ঘোষণা শোনা গেল, ‘‘আর কোনও দয়া দেখানো হবে না... প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট পান্ডাকে যেখানে দেখা যাবে গুলি করে মারা হবে। কমিউনিস্ট ডেপুটিদের আজ রাত্রেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো চাই।’’

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

বেঞ্জামিন কার্টার হেট মার্কিন দেশের ইতিহাসবিদ। নাৎসি জমানা নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন। সম্প্রতি তাঁর নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে: দ্য ডেথ অব ডেমোক্র্যাসি, হিটলার’স রাইজ় টু পাওয়ার (পেঙ্গুইন)। হিটলারের উত্থান নিয়ে তো অজস্র লেখালিখি হল। আর কেন? লেখকের প্রথম উত্তর: গত দু’আড়াই দশকে অনেক নতুন তথ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় উত্তর: প্রত্যেক যুগ ইতিহাসকে তার নিজের জায়গা থেকে দেখে, তার বিভিন্ন অর্থ নির্মাণ করে; আজকের পৃথিবীর কাছে হিটলারের অভ্যুত্থানের ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

এ বই শুরু হয় বার্লিনের রাইখস্ট্যাগ-এ অগ্নিকাণ্ডের কাহিনি দিয়ে। হিটলার নামক সর্বনাশের শেষের শুরুকে যদি কোনও একটি ঘটনা দিয়ে চিহ্নিত করতে হয়, তবে সেটা ঘটেছিল ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সেই রাত্রিতে। জার্মানির সংসদভবনে আগুন কে লাগিয়েছিল, তার নিশ্চিত উত্তর আজও মেলেনি। কিন্তু সেই রাত্রেই ওই বহ্নিমান রাইখস্ট্যাগের একটি ব্যালকনিতে দাঁড়ানো, এক মাস আগে চান্সেলরের আসনে বসা হিটলারের ঘোষণা শোনা গেল, ‘‘আর কোনও দয়া দেখানো হবে না... প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট পান্ডাকে যেখানে দেখা যাবে গুলি করে মারা হবে। কমিউনিস্ট ডেপুটিদের আজ রাত্রেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো চাই।’’ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সর্বাধিনায়কের এই ইচ্ছা নথিভুক্ত হল সরকারি বিবৃতিতে, হিটলারের ডান হাত, জার্মানির বৃহত্তম প্রদেশ প্রুসিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারমান গোয়রিং-এর সেই বিবৃতি জানাল: এই অগ্নিকাণ্ড ‘জার্মানির ইতিহাসে সংঘটিত জঘন্যতম বলশেভিক সন্ত্রাস’, এ হল ‘এক রক্তাক্ত বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের সঙ্কেত’। তত ক্ষণে অবশ্য এক অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক তারবার্তায় জানিয়েছেন যে আগুনটা নিঃসন্দেহে হিটলারের লোকেরাই লাগিয়েছে, এবং তারা সম্ভবত রাইখস্ট্যাগের স্পিকারের আবাসন থেকে একটি টানেল দিয়ে অকুস্থলে পৌঁছেছিল। স্পিকারের নাম? হারমান গোয়রিং।

সাংবাদিকরা সাংবাদিকের কাজ করেন, সরকার গ্রেফতার করে। সেই রাত্রেই বার্লিনের পুলিশ সযত্নে বানানো তালিকা ধরে ধরে দরজায় ধাক্কা দেয়। সেই তালিকায় আছেন কমিউনিস্ট, শান্তিকামী, ধর্মযাজক, আইনজীবী, শিল্পী, লেখক— নানা গোত্রের মানুষ, তাঁদের অপরাধ একটাই, তাঁরা নাৎসিদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, কাজ করেন। পুলিশ তাঁদের থানায় ধরে নিয়ে আসে। অন্য দিকে মধ্যরাত্রেই বেরিয়ে পড়ে নাৎসিদের নিজস্ব বাহিনী, তারা যাঁদের তুলে আনে, তাঁদের ঠিকানা হয় পরিত্যক্ত বাড়ি, গুদাম, জলের টাওয়ার, তাঁদের জন্য বরাদ্দ বেধড়ক মার, অত্যাচার, এমনকি মৃত্যু।

Advertisement

পরের দিন, ২৮ ফেব্রুয়ারি, বেলা এগারোটায় হিটলারের ক্যাবিনেট বিশেষ বৈঠকে বসে। ‘জনসাধারণ এবং রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য’ ডিক্রি জারি হয়। তার মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রের হাতে আপৎকালীন ক্ষমতা চাই, অতএব সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারগুলিকে খর্ব করা হবে, সরকার যাকে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করবে তাকে বিনা বিচারে বন্দি করা যাবে, পুলিশ কোনও পরওয়ানা ছাড়াই যে কোনও জায়গায় তল্লাশি চালাতে পারবে, বাক্‌স্বাধীনতা ছাঁটাই হবে, কার্যত বাতিল হবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার। রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে এই সবই দরকার, খুব দরকার। আর রাষ্ট্র সুরক্ষিত না থাকলে দেশের সুরক্ষা বজায় থাকবে কী করে? রাষ্ট্র বিনে দেশ নাই।

১৯১৯ সালে জার্মানির রাজনীতিতে হিটলারের প্রবেশ। তার পর চোদ্দো বছর ধরে সলতে পাকানো। চোদ্দো বছর ধরে বিরোধী এবং সহযোগী রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে বড় বড় পণ্ডিত, রাজনীতিবিশারদরা বলেছেন— দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই, গণতন্ত্র আছে, নির্বাচন আছে, সংবিধান আছে, সেই সংবিধানসম্মত নির্বাচনী গণতন্ত্রের কাঠামো মেনেই তো হিটলারকে কাজ করতে হবে, ভয় কিসের? ওয়াইমার রিপাবলিক-এর নতুন সংবিধানের জন্মও ওই ১৯১৯-এই। গণতান্ত্রিক অধিকারের মাপকাঠিতে এমন জোরদার সংবিধান দুনিয়ায় বিরল, মানবসভ্যতার শিখরে পৌঁছনোর অঙ্গীকার তার ছত্রে ছত্রে। এ হেন দেশে ওই বড় বড় কথা বলা ফালতু লোকটা কী করবে?

তার পর ১৯৩৩। বার্লিনের এক সাংবাদিকের ভাষায়, ‘‘প্রথমে রাইখস্ট্যাগ পুড়ল, তার পর বই, তার পর (ইহুদিদের) সিনাগগ। তার পর আগুন লাগল জার্মানিতে, ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, রাশিয়ায়...।’’ এই পরিণতি জার্মানি সে দিন ভাবতে পারেনি। গ্রন্থের উপসংহারে বেঞ্জামিন কার্টার হেট লিখছেন, যা ভাবা যায় না, তা ভাবতে না পারার জন্য জার্মানির মানুষকে দোষ দেওয়া কঠিন। কিন্তু তাঁদের এই চিন্তাদৈন্যের ফলেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করতে তাঁরা ভুল করলেন, সর্বনাশা ভুল। তার পর, বইয়ের শেষ বাক্যে, ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘‘আমরা পরে এসেছি, তাই জার্মানির সেই মানুষদের তুলনায় আমাদের একটা সুবিধে এই যে, তাঁদের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে।’’

সুবিধে থাকলেই যে আমরা তা কাজে লাগাতে পারব, এমন কোনও নিশ্চয়তা অবশ্য নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement