ধর্ম আসলে ‘ভাল ইতিহাসের নথিখানা’

সাবেকি ইতিহাস যাকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করতে চায় না, তাকেই প্রয়োগ করে চাপাপড়া স্বরকে গভীর প্রজ্ঞায় তুলে ধরেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ রণজিৎ গুহ।সাবেকি ইতিহাস যাকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করতে চায় না, তাকেই প্রয়োগ করে চাপাপড়া স্বরকে গভীর প্রজ্ঞায় তুলে ধরেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ রণজিৎ গুহ।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০১:১৫
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছোটবেলার ইস্কুলের বইতে লেখা থাকত অতীতের ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণই হল ইতিহাস। তবে ইতিহাস নিতান্ত সোজাসাপটা বিষয় নয়। অতীতের ঘটনা কী ভাবে জানব, কী ভাবেই বা লিখব? জানা আর লেখা দুয়ে মিলে সে এক গভীর দার্শনিকক্রিয়া। সেই দর্শনের পথে যিনি পথিক, তিনিই ইতিহাসবিদ। ‘বিদ্’ শব্দের অর্থ জ্ঞান, বোধ, জ্ঞাপন। সকলেই ইতিহাসবিদ নন, কেউ কেউ ইতিহাসবিদ— বঙ্গসন্তান রণজিৎ গুহকে সারা পৃথিবী একডাকে ইতিহাসবিদ বলে চেনে। শুধু ইতিহাসের পড়ুয়াদেরই নয়, এই প্রাজ্ঞ বাঙালির লেখাপত্র সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার জিজ্ঞাসুদের মন দিয়ে বুঝতে হয়। যাকে বলে ‘প্যারাডাইম শিফ্‌ট’, ইতিহাসচিন্তার জগতে তা ঘটাতে পেরেছিলেন তিনি।

Advertisement

১৯৮২ সাল। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকার তখন কিছু দিন হল ক্ষমতায় এসেছেন। প্রকাশিত হল ‘সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ’-এর প্রথম খণ্ড। ১৯৮২ সালের ১৫-১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে দুটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন রণজিৎ, সেই শোনার জন্য লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘এক্ষণ’ পত্রিকার বর্ষা ১৩৮৯ সংখ্যায়। সে দিন বলেছিলেন রণজিৎ, ‘ইতিহাসবিদ্যার একটা সংকটের মধ্যে আছি।’ খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ইতিহাসবিদ্যার জন্ম এদেশে ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে’, তাই ‘উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতিত্ব’ তার স্বভাব। এর বাইরে যেতে হবে। ১৯১৮-র আমেদাবাদের সুতোর কলের ধর্মঘটের ইতিহাস লিখতে গেলে মহাত্মা গাঁধী, শংকরলাল ব্যাংকার ও অনসূয়া সারাভাইয়ের জীবনের অভিজ্ঞতার সূত্রেই সেটিকে বিবৃত করা চলবে না, ধর্মঘটিদের চৈতন্যের ইতিহাস লিখতে হবে। এই নাম-না–জানা সাধারণ ধর্মঘটিরা মহাদেব দেশাই কিংবা তেন্ডুলকরের লেখায় গুরুত্বহীন।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস সাদা শাসকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন আধুনিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চলাচল করে গড়ে ওঠা উচ্চবর্গের প্রতিরোধের ইতিহাস হিসেবে রচনা করা হয়। অকথিত থেকে যায় এই উচ্চবর্গের চেতনার ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা শ্রেণি, গোষ্ঠী, ব্যক্তির একান্ত প্রতিরোধ। এ বার থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রের বাইরে থাকা এই শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিব জনতা, আদিবাসী, নিম্নবর্ণ, স্ত্রীলোক— এঁদের সচেতন ভাবে ইতিহাসের বিষয় বলে স্বীকার করতে হবে। ক্রমশই পশ্চিমবঙ্গের সরকার-পোষিত চিন্তকরা আশির দশকে মার্ক্সবাদকে যান্ত্রিক প্রণালীতে ঢালাই করে নির্ধারিত পথে সকলকে চালাতে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন, আর রণজিৎ গুহের সহযোগে সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের তরুণ ইতিহাস ও সমাজভাবুকেরা প্রশ্নপরায়ণ হয়ে শুনতে চাইলেন চাপা পড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরগুলিকে। এ কেবল ইতিহাস লেখা নয়, বৌদ্ধিক ব্যায়াম নয়, রণজিৎ গুহের কাছে ইতিহাসচর্চা ইতিহাসযাপন। সে দিন সেই ’৮২ সালে, কলকাতা শুনেছিল তাঁর কণ্ঠে, ‘আমাদের সাধনাকে নতুন তাত্ত্বিকতা, নতুন তথ্য ও নতুন পদ্ধতি দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।’ রবীন্দ্রনাথ যেমন সাহিত্যে শুধু জীবনের তথ্যকে প্রকাশ করতে চাননি তেমনই রণজিৎ বলেছিলেন, ‘তথ্য ছাড়া ইতিহাস হয় না ঠিকই, কিন্তু তা নিছক তথ্য নয়।’ সে দিন, সেই আশির দশকের গোড়ায় কেউ ভাবতেও পারেননি কিন্তু পরে দেখা গেল ইতিহাসবিদ রণজিৎ এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্ররচনার সামনে। ২০০২-এ প্রকাশিত হল রণজিতের ‘History at the Limit of World-History’. এ বই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-এর লেখক রামরাম বসুকে। আর এ বইয়ে আলোচিত রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচিন্তা। রণজিৎ বেছে নেন রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা’ নিবন্ধটিকে— রবীন্দ্রনাথ এই লেখায় ইতিহাসের নয়, সাহেবদের হাত-ফেরতা হয়ে ইতিহাস লেখার প্রচলিত যে পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল তার বিরোধী। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে এর পর আরও দুটি বই লিখবেন রণজিৎ। ‘কবির নাম ও সর্বনাম’, ‘ছয় ঋতুর গান’।

Advertisement

ইতিহাসবিদ হিসেবে শিকড়কে কখনও অস্বীকার করেননি তিনি। ১৯২৩-এ বাখরগঞ্জের সিদ্ধকাঠি গ্রামে মাঝারিবিত্তের তালুকদার পরিবারের ছেলে তিনি। গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা শুরু। বাবা কলকাতায় আইনজীবী। তাই ১৯৩৪-এ কলকাতায় হ্যারিসন রোডের মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভরতি হলেন। ১৯৩৮-এ প্রেসিডেন্সি কলেজ। সেখানেই বামপন্থী রাজনীতিতে হাতেখড়ি। এই রাজনৈতিক সচেতনতা তাঁকে আর এক রকম ভাবে বইমুখী করেছিল, বামপন্থী রাজনীতির চাপে কলেজের ক্লাস-পড়াশোনা নিয়মিত করা হয় না। তাই অনার্স ছাড়াই গ্র্যাজুয়েট হলেন। মাস্টারমশাই সুশোভন সরকার অবশ্য ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন এই মেধাবী প্রশ্নশীল যুবকটিকে। ক্লাসঘরের বাইরে অন্য পড়াশোনার হাতেখড়ি, ১৯৪৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণির এমএ। তার পরেই কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার, ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যোগদান, প্যারিসযাত্রা। সেখানে সাংগঠনিক কাজকর্ম, পূর্ব ইউরোপে, উত্তর আফ্রিকায়, পশ্চিম এশিয়ায় নানা দেশে ঘুরেছেন, কখনও ঘুরতে হয়েছে ছদ্মপরিচয়ে। ১৯৫৩-য় দেশে ফিরলেন— পড়ানোর কাজ পেলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। প্রশ্নশীল মনের মানুষ বলেই ১৯৫৬-য় সোভিয়েতের হাঙ্গেরি আক্রমণের প্রশ্নে পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গেল। বুঝতে পারলেন, পার্টি চেতনাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে ঢালাই করে নিতে চায়। সিদ্ধকাঠি গ্রামের ছেলেটি শিকড়ের টানকে উপেক্ষা করেন না, কিন্তু প্রশ্নের ডালপালাকে ছেঁটে ফেলে তাঁকে টবের গাছ হিসেবে আটকে রাখার উপায় নেই। বামপন্থী রাজনীতির অভিজ্ঞতা তাঁকে কৃষক চৈতন্যের স্বরূপ বুঝতে উদ্বুদ্ধ করেছে, চিরস্থায়ী ব্যবস্থার চরিত্র নির্ধারণ করতে সচেষ্ট করেছে। আধিপত্য ও ক্ষমতার চরিত্র ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। মার্ক্সবাদ তাঁর কাছে খোলামেলা পদ্ধতি, সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান মার্ক্সের পুরোহিত তিনি কোনও দিনই হয়ে উঠতে চাননি। প্রয়াত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ই পি টমসন রণজিতের চেয়ে সামান্য ছোট। টমসনও ১৯৫৬-য় সোভিয়েতের হাঙ্গেরি দখলের প্রশ্নে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেছিলেন। কেউ কেউ টমসনের সঙ্গে তুলনা করেন বাঙালি রণজিতের। তবে ইতিহাসকে রণজিত যে তাত্ত্বিকতায় উন্নীত করেছেন সে পথে এমন করে চলাচল করেননি টমসন। ইতিহাস দর্শনের সন্ধানে রণজিৎ মার্ক্স, কান্ট, হেগেলের শরণ নেন, অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে বোঝার জন্য ভারতীয় আলংকারিকদের দ্বারস্থ হতেও দ্বিধা করেন না।

ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও তিনি সমান সচল। কর্মসূত্রে বিদেশবাসী বলে এবং নিজের ভাবনাকে বিশ্বের নানা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইংরেজিই তাঁর জ্ঞানচর্চার অন্যতম ভাষা, একমাত্র নয়। জীবনের বিকেলবেলায় তাঁর কলম বাংলা ভাষার প্রতি সমর্পিত। রামমোহনের দয়া, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার প্রেমভাবনা, সুনীল-শঙ্খের কবিতা তাঁর লেখার বিষয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি চেয়েছেন ইতিহাসের নথিখানার সীমা সম্প্রসারিত করতে। সাবেকি ইতিহাস যাকে প্রমাণ হিসেবে মানতে চায় না তাকে প্রমাণের গোত্রে প্রয়োগ করে চাপাপড়া স্বরকে তুলে ধরেন তিনি, আর লেখক হিসেবে খুঁজে নিতে চান অদেখা অচেনা অলি-গলি। যা ক্ষুদ্র তা তুচ্ছ নয় জীবনের অভিজ্ঞতা আর বোধ থেকে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন। হিন্দুত্বের একমাত্রিক স্বরের দাপট যখন প্রবল হয়ে উঠছে তখন রণজিতের লেখা উদ্ধার করে বলতে ইচ্ছে করে এই উপমহাদেশের বৃহত্তম নথিখানা হল ধর্ম। সহযোগ, প্রতিরোধ, আধিপত্য, পরাভবের নানা ছোট-বড় মুহূর্তের সাক্ষ্যবাহী এই নথিখানাকে একের স্বার্থে একমাত্রিক ভাবে ব্যবহার করা অন্যায়। তাই যা ক্ষুদ্রকে, স্বরের বিভিন্নতাকে ঠাঁই দেয়, তাই ভাল ইতিহাস। ধর্মের নথিখানাতে স্বরের বিভিন্নতা ধরা আছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement