চড়কের ঢাকে আওয়াজ পড়লেই সাবেক বছরের ইতি-রেখা আলপনার স্বস্তিক এঁকে দেয় নববর্ষের দরজায় দরজায়। ডাব-মিষ্টি-হালখাতা-পাঁজি-নতুন জামা আর গোলাপজলের ফুর্তি-ফোয়ারায় হাজির হয় নববার্ষিক বৈশাখী পয়লা। হুতোম প্যাঁচার আড়ালে কালীপ্রসন্ন সিংহর (১৮৪০-১৮৭০) রস-ব্যাখ্যা—
আজ বুড়টি বিদায় নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন। বুড় বৎসরের অধীনে আমরা যে সব কষ্ট ভোগ করেচি, যে সব ক্ষতি স্বীকার করেচি—আগামীর মুখ চেয়ে আশার মন্ত্রণায় আমরা সে সব মন থেকে তাঁরই সঙ্গে বিসর্জন দিলেম।
ভদ্রপল্লির আবহমান আবেগের বিপ্রতীপে আনন্দের নেশাজলে ভিন্ন খুশির ফোয়ারা ছোটে ‘বে-পাড়া’-র আদর-দানে। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়-এর (১৮২০-১৮৮৫) অভিজ্ঞতায়—
পূর্ব্বে গ্রীস দেশে যেমন পণ্ডিত সকলও বেশ্যালয়ে একত্রিত হইয়া সদালাপ করিতেন সেইরূপ প্রথা এখানেও প্রচলিত হইয়া উঠিল। যাঁহারা ইন্দ্রিয়াসক্ত নহেন, তাঁহারাও আমাদের ও পরষ্পর সাক্ষাতের নিমিত্ত এই সকল গণিকালয়ে যাইতেন।...রাত্রি দেড় প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয় লোকে পরিপূর্ণ থাকিত।...পর্ব্বোপলক্ষে তথায় লোকের স্থান হইয়া উঠিত না।
‘সঞ্জীবনী’-সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রর (১৮৫২-১৯৩৬) আত্মচরিতে মেলে—
তখন বাইখেমটা নাচ প্রচলিত ছিল। ভদ্রলোকেরা তাহা দর্শন করা অন্যায় বলিয়াই মনে করিতেন না।
ব্রহ্মবাদী সমাজ-সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭-১৯১৮) নিরীক্ষায় মূর্ত ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্য ভাবে বারবিলাসিনীগণের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিতে লজ্জা বোধ করিতেন না। তখন উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্য ভারতবর্ষ হইতে এক শ্রেণীর গায়িকা ও নর্ত্তকী শহরে আসিত, তাহারা বাঈজী এই সম্ভ্রান্ত নামে উক্ত হইত। নিজ ভবনে বাঈজীদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন ধনী কোন প্রসিদ্ধ বাঈজীর জন্য কত সহস্র টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ সহরের ভদ্রলোকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমনকি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা প্রধান উপায়স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।...বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ-আকড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত।
দাশরথি রায়ের (১৮০৬-১৮৫৭) পাঁচালিতে কালের একই প্রকাশ হয়ে উঠেছে রীত নীত, পর-বনিতে মনোনীত,
বারবনিতা ভিন্ন হয় না বিহার।
ঐ ব্যাপার বাড়াবাড়ি, মনে থাকে না ঘরবাড়ী
রাঁড়ের বাড়ী তৃপ্তিপূর্ব্বক আহার।
সমকালীন কলম-কাব্যে সমান অভিমত বটতলার বইচিত্রে—
বেচেকিনে বাড়ির পাটা, বেশ্যায় কিনে দেয়গো কোটা,
নববর্ষে ভারি ঘটা বেশ্যার সংসারে।
মেঘনাদ গুপ্তর আড়াল-নামে হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) ছবি এঁকেছেন নববর্ষ-সঙ্গী জীবনের—
ট্যাক্সিতে চড়ে যাচ্ছে অধিকাংশ হঠাৎ-বাবুর দল। বাপ-মায়ের লোহার সিন্দুকে বা গয়নার বাক্সে সকলের অগোচরে হাত চালিয়ে, বা হ্যান্ডনোট কেটে বা অন্য কোনও উপায়ে এদের অনেকে হঠাৎ কিছু টাকা সংগ্রহ করেছে—এরা তারই সদ্ব্যবহার করতে চলেছে।... সোনাগাছি বা রুপোগাছির কাছে গিয়ে অধিকাংশ গাড়িই খালি হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে যারা নামছে তাদের ভিতরে সুবর্ণ গর্দ্দভ, মাড়োয়ারি বা হঠাৎ বাবুরাই নেই—একটু কাছে এগিয়ে গেলেই দেখবেন, অনেক বিখ্যাত জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট, ব্যারিষ্টার, উকিল, অ্যাটর্নি, ডাক্তার, এম এল সি, নন-কো-অপারেটর, বক্তা, পণ্ডিত, সম্পাদক ও সহিত্যিকও এই দলে আছেন। এমনকি, শহর থেকে বারবণিতা উঠিয়ে দেবার জন্য যে-সব সচ্চরিত্র সাধু ব্যক্তি প্রকাশ্য সভায় প্রা়ঞ্জল ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাহাদুরি নিচ্চেন, তাঁদেরও কেউ কেউ যে এ দলে নেই, এমন মিথ্যা কথা আমি বলতে পারব না।
পাশাপাশি ধনী রাজগৃহে পয়লা বৈশাখে বসত শাস্ত্র-আলোচনা-সভা। সভা শেষে বাঈ-নাচের আসর। রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুরের (১৭৮৩-১৮৬৭) আমলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পয়লা বৈশাখে বসত তেমনি পণ্ডিত সম্মেলন। ভিন্ন পরিবেশের সে উৎসবের আদ্যোপান্ত ছবি মেলে দীনবন্ধু মিত্র-র (১৮৩০-১৮৭৩) সুরধনী কাব্যে—
বসিয়াছে বাবুগণ করি রম্য বেশ
মাথায় জরির টুপি, বাঁকাইয়া কেশ,
বসেছে সাহেব ধরি চুরুট বদনে,
মেয়াম ঢাকিছে ওষ্ঠ সোহন ব্যজনে,
নাচিছে নর্ত্তকী দুটি কাঁপাইয়ে কর, মধুর সারঙ্গ বাজে কল মনোহর,
সু-লয়ে মন্দিরে বাজে ধরা দুই করে,
সু-তানে তবলা বাজে রক্ষিত কোমরে...
সম্মান-সবিতা রাধাকান্ত মহারাজ,
আসীন লইয়ে বিজ্ঞ পণ্ডিত সমাজ।।