Christmas

বাঙালিয়ানায় ভরপুর চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলা

ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রঙিন নদিয়া জেলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ।

Advertisement

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৭:৪৯
Share:

ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রঙিন নদিয়া জেলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে নানা ধরনের মেলা। এরই মধ্যে অনেকটাই ব্যতিক্রমী শতবর্য অতিক্রান্ত চাপড়ায় বড়দিনের খ্রিস্টীয় মেলাটি। বাংলায় খ্রিস্টীয় মেলার সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে নদিয়া জেলার বড় মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম এই মেলাটি। এক সময় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বর্ষ শেষে মানুষের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।

Advertisement

চাপড়ার প্রোটেস্টান্ট গির্জার কাছে কিং এডওয়ার্ড স্কুলের মাঠে বসে এই মেলা। স্থানীয়দের কথায়, ‘‘এখানকার মানুষ বছরভর প্রতীক্ষা করেন এই মেলার জন্য। কিং এডওয়ার্ড হাই স্কুলের টিচার ইন চার্জ এবং মেলার সম্পাদক সিম্পসন মোল্লা জানালেন, যত দূর জানা যায় মেলাটি শুরু হয় বাংলাদেশের রতনপুরে। পরবর্তী কালে চাপড়ায় শুরু হয় মেলা। এ বার মেলা ১০২ বছরে পদার্পণ করল। মেলার পাশাপাশি চাপড়া খ্রিস্টীয় সমাজের বেশ কিছু নিজস্বতা আছে যাতে মিশে আছে চিরন্তন বাঙালিয়ানা। খ্রিসমাস ক্যারলের পাশাপাশি বড়দিনের প্রর্থনায় গাওয়া হয় খ্রিস্টীয় কীর্তনও। এই উপলক্ষে প্রতি বছর রচনা করা হয় নতুন নতুন কীর্তনও।

চাপড়া গীর্জা

Advertisement

হঠাৎ শুনে চমক লাগতেই পারে। খ্রিস্টীয় কীর্তন? তবে এটাই এখানকার ঐতিহ্য। লেখক, গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর একটি লেখায় থেকে জানা যায় অতীতে এখানকার খ্রিস্টমণ্ডলীর পাদ্রি ছিলেন মতিলাল মল্লিক। তিনি নবদ্বীপে গিয়ে কীর্তন শিখে এসে চাপড়ায় খ্রিস্টীয় কীর্তনের প্রবর্তন করেন। সেই ধারা আজও চলছে। বড়দিন কিংবা ইস্টারের সময় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ভক্তরা আজও কীর্তন গেয়ে পথ পরিক্রমা করেন।

বড়দিনের মেলা চলে ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই উপলক্ষে প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকাও। হয় নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও টুর্নামেন্ট। হয় লাঠি খেলাও। থাকে হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ও বিক্রি। সেই তালিকায় কাঁথা, পাটের জিনিস থেকে শুরু করে থাকে বাড়িতে তৈরি রকমারি পিঠে পুলিও। হয় একটি পশুপাখির প্রদর্শনীও। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হয় যাত্রা, পালাগান, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা এবং আবৃত্তিও। স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, মেলায় প্রতিদিন কম করে কুড়ি হাজার মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে। আর যে দিন ফুটবল টুর্নামেন্ট থাকে, সে দিন লোকসংখ্যা হয় পঞ্চাশ হাজারের মতো। আগত মানুষের রসনার তৃপ্তির জন্য থাকে অসংখ্য খাবারের স্টলও।

সময়ের প্রভাবে বড়দিনে বিভিন্ন ধরনের কেকের প্রাধান্য বাড়লেও আজও বাড়ি বাড়ি চল আছে পিঠে-পুলি কিংবা নলেন গুড়ের পায়েসের। সামর্থ অনুযায়ী খ্রিস্টান পরিবারগুলিতে ভালমন্দ হরেক পদের আয়োজন আর আত্মীয় কুটুম্বের সমাগম লেগে থাকে। এ সময় প্রবাসীরা উৎসবের টানে ঘরে ফেরেন। আগে চাপড়ার ক্রিশ্চান অধ্যুষিত পাড়ায় বেশির ভাগ বাড়ির সামনে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে তার উপর দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে বিশেষ প্রবেশদ্বার তৈরি করা হত। এখন গাছ কাটার ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেবদারু পাতার পরিবর্তে রঙিন ঝালর, ঝকমকে প্লাস্টিকের সাজ সামগ্রী আর এলইডি আলো দিয়ে প্রবেশপথ, বসার ঘর সাজানো হয়। কোথাও বা দেখা যায় ঝকমকে রঙিন ‘ক্রিসমাস স্টার’। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে মাইকের দাপট। কিছু কিছু বাড়িতে উচ্চগ্রামে গান বাজানোটা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেমনটা হয় পুজো-পাবর্ণে। শহুরে বড় দিনের চেয়ে আজও অনেকটাই আলাদা আটপৌরে চাপড়ার বড়দিন।

স্থানীয় বাসিন্দা তথা শিক্ষক অরূপ সাহা বলছিলেন, ‘‘চাপড়ায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কম, তবুও বড়দিনের এই মেলা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানের এক মিলনমেলার রূপ পেয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় সাজানো হয় গোশালা। সময়ের সঙ্গে এসেছে কিছু পরিবর্তন। বেড়েছে এলইডি আলোর ব্যবহার। তবু হারায়নি শিকড়ের টান।’’

ইতিহাস বলে, ১৮৩১ নাগাদ বর্ধমানের এক ডব্লু জে ডিয়ার নদিয়ায় আসেন। কৃষ্ণনগরে তিনি একটি স্কুলও স্থাপন করেন। সেটাই কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন‌্স সি এম এস স্কুল। কৃষ্ণনগরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গ্রামে ডিয়ার কিছু কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষের সংস্পর্শে আসেন যাঁরা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলেছিলেন। ১৮৩৩ নাগাদ এঁদেরই ৩৩ জন খিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। পরে ১৮৩৮-এ পার্শবর্তী আরও দশটি গ্রামের আনুমানিক ৫০০ মানুষ খিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কট্টর ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের শাসনে নিম্নবর্গের বেশ কিছু মানুষ আগেই কর্তাভজা হয়ে গিয়েছিলেন। প্রাদ্রির প্রয়াসে তাঁদের ধর্মান্তকরণ ঘটে। অনেকেই মনে করেন দ্বীপচন্দ্রপুরের পুরনো বাসিন্দারা ছিলেন কর্তাভজা। পরে তাঁরাই প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ করে চাপড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। চাপড়া প্রোটেস্টান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৪১ সালে। কত নিম্নবর্ণের অবহেলিত মানুষ এখানে পেয়েছে জীবনে স্বীকৃতি আর পায়ের নীচের মাটি।

চলমান সংস্কৃতির ধারা আজও বহমান চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলা এবং কীর্তনের ধারায়।

আরও পড়ুন: ক্রিসমাস ট্রি কী ভাবে সাজাবেন

এ বার বড়দিনে নিজেই বানান কেক, কুকিজ

‘বড়দিন আমার প্রেমের দিন’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement