লালবিহারী দে-র চন্দ্রমুখীর উপাখ্যান-এ (১৮৫৮) রমণীরা অভিভূত হয়ে দেখলেন একটা ‘বৃহৎ চোঙ্গা হইতে রাশি ২ ধূম নির্গত হইতেছে ও এক সারি কাষ্ঠ নির্ম্মিত ঘর অতি বেগে দৌড়িতেছে।’ ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর প্রসঙ্গে এই ‘ঘর’, মানে রেলকে দীর্ঘকাল যে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে আসছে, মধ্য-অষ্টাদশ থেকে উনিশ শতকের শেষদিক পর্যন্ত বিহারের যোগাযোগ- ব্যবস্থা-র আলোচনায় তাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন নীতীন সিংহ। লিখছেন, ঘুরে ঘুরে স্থানীয়দের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহের পুরনো ছকটা কাজে লাগিয়েছে সরকার, আর এ ভাবেই বিহারের প্রচলিত যোগাযোগ-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার পথ সুগম হয়েছে। এর জন্য চালু ব্যবস্থা উৎখাত হয়নি, যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার সামান্য রদবদল হয়েছে মাত্র। একটা যেন সহাবস্থান— রেল সব নষ্ট করেনি। যেমন জলপথ পরিবহণে গঙ্গার ভূমিকা দীর্ঘকাল অপরিবর্তিত। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দক্ষিণ বিহারে রেল চালু হওয়ার পরেও সমান গুরুত্বে রইল। সেই ধারাবাহিকতার গল্প। যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ব্যবসা, পণ্য উৎপাদন, জরিপ, অপরাধ, ভ্রমণ, স্মৃতিকথা নানা বিষয় এক জায়গায় ধরতে চেয়েছেন নীতীন। এই পদ্ধতির সমস্যা সম্পর্কে সচেতন বলেই গোড়ায় স্বীকার করে নিয়েছেন, প্রচলিত ছকে সাজানো নয় বলে কিছুটা অসঙ্গতি লাগতে পারে।
ঠিকই। রেল চালু হলেও মানুষের আসাযাওয়া যদি আগের মতোই ছিল তা হলে কেন ভূবিজ্ঞানী ভ্যালেন্টাইন বল লিখলেন, রেল চালু হওয়ায় জি টি রোড থেকে গয়া বা পরেশনাথগামী তীর্থযাত্রীর দল উধাও হয়ে গেল? সব পুরনো রাস্তা তো অক্ষত থাকেনি। মেদিনীপুর অঞ্চলের প্রাক-ঔপনিবেশিক একুশটি বিলুপ্ত পথের হদিশ দিয়েছিলেন তারাপদ সাঁতরা। মুঙ্গের সীতাকুণ্ডের পাণ্ডাদের ‘হাহাকার’-এর কথাও তো জানা।
বাংলার পথ। স্যামুয়েল বোর্ন, ১৮৬৫।
‘আর্থিক অসুবিধা থাকায় কয়েদিদের সাহায্যে পর্যন্ত পথঘাট তৈরিতে উদ্যোগী ছিল সরকার’— এ জাতীয় মন্তব্যে নীতীন কি কাউকে আড়াল করতে চাইলেন? যোগাযোগ-ব্যবস্থা তৈরিতে সরকারি বাধ্যবাধকতা আলোচ্য বিষয় হওয়া সত্ত্বেও ভারতের পথঘাটে ভ্রমণকারী তীর্থযাত্রীদের কথা বা ১৮৫৭-র মতো বড় ঘটনার ভূমিকা কেন আলোচনার বাইরে রইল? ‘Gooskarah station in Raneegunje’ জাতীয় ভুল নিশ্চয়ই পরবর্তী সংস্করণে সংশোধিত হবে। গ্রন্থপঞ্জিতে ভোলানাথ চন্দ্র, এনুগুলা বীরস্বামী বা ফ্যানি পার্কস-এর অনুপস্থিতি নজরে পড়ে।
রেল সম্পর্কে দেশীয়দের প্রতিক্রিয়ার কথা বিশেষ লিখছেন না বলেও ওয়াগনে বেশি জায়গা পেতে স্টেশনমাস্টারকে ব্যবসায়ীদের ঘুষ দেওয়ার মতো অনেক অপরাধের জন্মদাতা রেল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত কিছু দেশীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন নীতীন। তবে কি না জাত নষ্ট করা সেই তিন ‘সেন’-এর অন্যতম ‘ইষ্টিসেন’-এর কথাই বা ভুলি কেমনে?
আর এই রেলই কেমন করে ১৭৮০ থেকে ১৯১৪-এর মধ্যে ওড়িশার প্রাক্-ঔপনিবেশিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভিমুখটা বদলে দিল তা রবি আহুজার অন্যতম আলোচ্য বিষয়। প্রাক্-ব্রিটিশ যোগাযোগ-ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে অনেকেই ব্রিটিশ আমলের ‘উন্নত’ সড়ক আর রেলপথকে জনস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করেন বলেই দক্ষিণ এশিয়ায় যোগাযোগ-ব্যবস্থার সামাজিক ইতিহাস গবেষণাটা ত্রুটিপূণ থেকে যায় বলে তাঁর মত। রবি বলছেন, পরিবহণ ব্যবস্থায় ‘পর্যাপ্ত’, ‘উপযুক্ত’— এ সব শব্দের অর্থ সময়ভেদে পাল্টায়। পুরনো রাস্তাঘাট আর সেতুকে ‘মফস্সল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে ব্যঙ্গ করে নিজেদের সৃষ্টির ‘আধুনিকতা’কে তারা ‘সেলিব্রেট’ করেছে। অথচ পস্কো এখন বলছে, ওড়িশায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনও যোগাযোগ পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এই ‘good road’-এর সংজ্ঞা সমাজের প্রভাবশালী অংশের চাহিদা অনুযায়ী ক্রমাগত বদলায় বলেই ইংরেজ শাসন চালু হওয়ার প্রাক্কালে ওড়িশাকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন আদিম গ্রামসমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে নারাজ লেখক।
বইতে যখন পড়ি ভারতীয় রেল-এর ফোকাস বাংলাতেই ১৮৫০-এর দশকেও সব দেশি নৌকো ডুবে যায়নি, তখন আর ফকিরমোহন সেনাপতির বাল্যকালে ‘বালেশ্বর জাহাজাদির বড় কারবার স্থল’-এর উল্লেখ অবিশ্বাস্য ঠেকে না। আর, তামিল পর্যটক এনুগুলা বীরস্বামী তো ১৮৩০-এর দশকেই বালেশ্বরের জমজমাট দূর-বাণিজ্যের কথা বলেছিলেন। সরকার যখন ১৮৬৬-র ওড়িশা-দুর্ভিক্ষের প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবকে দায়ী করলেন, তখন শ্বেতাঙ্গ সমালোচকরাই তার বিরোধিতা করে ওড়িশার ছোটখাট বন্দর আর বাষ্পীয় জাহাজের প্রাচুর্যের কথা বলেন। মহানদী-র তীরে কটক, কান্টিলো ছাড়াও জাজপুর বা খুরদা-র মতো বহু জনপদের উল্লেখ করেছেন রবি আহুজা, যেখানে অনেক কাল ধরে বানজারা আর মধ্যভারতের অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওড়িশার বাণিজ্য চলত। তাঁর মতে, ১৮৭০-এর দশক থেকেই অবক্ষয়ের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের প্রয়োজনে আরেকটা ‘circulatory regime’-এর সূচনা হয়। ফলে মধ্যভারতের সঙ্গে যোগাযোগটা ফিকে হয়ে ওড়িশা পরিণত হয় কলকাতার ‘periphery’-তে।
নীতীন সিংহ। অ্যানথেম প্রেস, ৫৯৫.০০
পাথওয়েজ অব এম্পায়ার, রবি আহুজা।
ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ৬৯৫.০০
তবে তার জন্য সরকারকে কম বেগ পেতে হয়নি, কারণ অগম্যতাই যখন ছিল গড়জাত রাজাদের রক্ষাকবচ। রাস্তায় কাঠ ফেলে অতীতে তাঁরা মরাঠাদের পথও রুদ্ধ করেছেন। পরে অবশ্য নতুন ব্যবসায় উপকৃত আঠমালিকের মতো গড়জাত রাজারা ‘উন্নয়ন যজ্ঞের’ অংশীদার হয়ে ‘enlightened’ খেতাব পেলেন। পাণ্ডারাও রেলপথের সদ্ব্যবহার করেন। তীর্থযাত্রার সুযোগ রেল প্রসারিত করে, এ কথা স্বীকার করেও লেখক যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্ন তুলেছেন। থার্ড ক্লাসের যাত্রীদের ক্লেশ, হুতোম-এর কথায়, ‘ব্লাক্হোলবদ্ধ সাহেবদের যন্ত্রণা হতে কোনও অংশে কম নয়’। সত্যিই পাণ্ডারা খুশি হয়েছিলেন কি না বলা শক্ত। যদুনাথ সর্বাধিকারীর তীর্থ-ভ্রমণ বইটি প্রসঙ্গে যাদবেশ্বর শর্মা লেখেন, ‘রহিয়া রহিয়া, সহিয়া সহিয়া, জিরাইয়া জিরাইয়া, চটীতে চটীতে অবস্থিতি করিয়া’ তীর্থে যাবার যে আনন্দ, রেলের গাড়িতে ‘তড়ীঘড়ী তীর্থপ্রাপ্তিতে... সে বোধ আসিতে পারে না।’
তবুও রেল তো উপমহাদেশের সমাজচিত্রটাই বদলে দেয়। আর সব সময় শুধু সাম্রাজ্যবাদের দোষ দেওয়া কেন, পুরনো ব্যবস্থা নষ্ট করে প্রকৃতিকে বলাৎকার কি স্বাধীন ভারতে হয়নি? কত বাঁধ-জলাধার রুদ্ধ করেছে নদনদীর স্বাভাবিক গতিপথ, কত জঙ্গল পাহাড় চিরে রেলপথ তৈরি হল। এমন ঘটনা তো অজস্র।
রবি আহুজার বইয়ের অনেকটা অংশ জুড়ে যে তত্ত্বের অবতারণা সে প্রসঙ্গে মনে হয়, ধার করা পোশাকে না সাজালেও ইতিহাস আকর্ষণীয় হতে পারে। আর সেটাই ঐতিহাসিকের মুন্সিয়ানা। এ বইয়ে তথ্যগত কিছু সমস্যাও আছে। বুঝলাম না, সুখময় রায় কবে উত্তরপাড়ার রাজা ছিলেন। মানচিত্রগুলোর আরও পরিচিতি প্রয়োজন ছিল। ছোট আকারে হলেও অষ্টাদশ শতকে বাংলার পরিবহণ-ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা করেছেন তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় (পলিটিক্যাল কালচার অ্যান্ড ইকনমি ইন এইটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল)। এই কাজকে আর একটু এগিয়ে নিয়ে গেলে সুবা বাংলার যোগাযোগ-ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক ইতিহাস তৈরি হতে পারে।
মহিষাদল রাজ কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক