পুস্তক পরিচয় ৩...

স্বাধীন দেশে নিহিত পরাধীনতা

চল্লিশ বছর আগে, সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে উঠত রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে যারা বিদ্রোহ করেছে সেই রাজবন্দিদের ঘিরে, তাদের কেন্দ্র করেই চলত সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের স্টিম-রোলার। সেই জেলখানায় সবচেয়ে অসহায় ছিল নিরপরাধ বন্দিরা, তাদের সমস্ত অধিকারই ছিল পদদলিত। তারপরে অসহায় ও অত্যাচারের শিকার ছিল বিচারাধীন বন্দিরা...।’— প্রাককথন-এ জানিয়েছেন মীনাক্ষী সেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ২০:১৫
Share:

চল্লিশ বছর আগে, সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে উঠত রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়ে যারা বিদ্রোহ করেছে সেই রাজবন্দিদের ঘিরে, তাদের কেন্দ্র করেই চলত সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের স্টিম-রোলার। সেই জেলখানায় সবচেয়ে অসহায় ছিল নিরপরাধ বন্দিরা, তাদের সমস্ত অধিকারই ছিল পদদলিত। তারপরে অসহায় ও অত্যাচারের শিকার ছিল বিচারাধীন বন্দিরা...।’— প্রাককথন-এ জানিয়েছেন মীনাক্ষী সেন। তাঁর জেলের ভেতর জেল অখণ্ড প্রকাশ পেল সম্প্রতি (কারিগর, ৬৫০.০০)। সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলনে শামিল হওয়ার কারণে কারাবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল মীনাক্ষীর, তাঁর বয়স তখন উনিশ থেকে তেইশে পৌঁছচ্ছে। জেলের বাইরে এসে যখন লেখা শুরু করেন বয়স তখন চব্বিশ, তাঁর মনে পড়ে ‘সে সময় লিখতাম, ছিঁড়তাম, কাঁদতাম আবার লিখতাম, মনে হত যা দেখে এসেছি তা লেখা হয়নি, যা অনুভব করেছি, তার একভাগও প্রকাশ করতে পারছে না আমার লেখা, সেই অপূর্ণতার আক্ষেপ নিয়েই যেন এক কর্তব্যবোধের তাড়নায় লিখতাম।’ ১৯৯১-তে স্পন্দন থেকে প্রথম প্রকাশ পায় ‘পাগলবাড়ি পর্ব’, ১৯৯৮-এ প্রতিক্ষণ থেকে পরবর্তী পর্ব ‘হাজতি নম্বর মেয়াদি নম্বর’। কেবল কারাবাসের কাহিনি ভাবলে প্রায় ভুলই ভাবা হবে মীনাক্ষীর রচনাকে, জেলবন্দিদের অসহনীয় অবস্থা বা অমানবিক জীবনযাপনের আখ্যান লিখতে লিখতে যেন স্বাধীন দেশে নিহিত পরাধীনতার খোঁজ করে চলেন তিনি নিত্য। দীর্ঘ দু’শো বছরের পরাধীনতা যেমন আমাদের মানবসম্পর্ককে দলে-মুচড়ে দিয়েছে, তেমনই জটিল করে ফেলেছে আমাদের আত্মপরিচয়কেও। ফলে মীনাক্ষীর মতো আখ্যানকার এই জটিলতার ভিতর দিয়ে যেতে-যেতেই তাঁর স্মৃতি বা অভিজ্ঞতার নতুন নতুন স্তর আবিষ্কার করেন, যেমন তাঁর একটি অধ্যায় ‘লক্ষ্মী-পরিচয়’, লিখছেন ‘রিংকুর মতো লক্ষ্মীও ডাকাতি কেসের মেয়ে। রিংকুর মতোই তার শক্তপোক্ত চওড়া গড়ন। পাঁচ ফুট ইঞ্চি দুয়েক লম্বা। চওড়া কাঁধ, চ্যাটালো পিঠ। এই নিয়ে সে এক পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করতে চেষ্টা করে সদা সর্বদা। হাঁটে ছেলেদের মতো করে। কথা বলে গলায় কৃত্রিম কর্কশতা এনে। শাড়ি কখনো পরে না। সায়াটাকে হাঁটুর কাছে তুলে গিঁট দিয়ে রাখে, খেটে-খাওয়া মানুষ যেভাবে লুঙ্গি ভাঁজ করে তুলে পরে কাজের সময়— সেই ভাবে। ব্লাউজটাকে এমনভাবে চেপে টেনে আটকায় যাতে সমতল দেখায় তার বুক।’

Advertisement

আরও এক জেলখানার ইতিবৃত্ত স্বাতী গুহের নীলা ও ফুলচোর কাকের গল্প-এ (গাঙচিল, ২০০.০০)। ‘পুলিশের গাড়ি চেপে একটা উঁচু দেওয়ালের আটকানো বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ার অনেক অনেক দিন পর জানতে পেরেছিল এটাকে হোম বললেও, এটা আসলে জেলখানা। আর সেদিন থেকেই আবার পালানোর জন্য তার বুকের খাঁচাটা ছটফট করতে থাকে।’— ‘বিদ্যুৎ’, এই গল্পগ্রন্থেই একটি গল্প। গল্পটির মূল চরিত্র ইলেকট্রিক্যাল রিফিউজ নিয়ে কাজ-করা নীরু, তার মতোই এই সংকলনের কুড়িটি গল্পে চলাচল করে বিভিন্ন ধরনের মানুষ— প্রতিমাশিল্পী থেকে শুরু করে কম্পোজিটর বা কায়াকির ব্যবসায়ী লুকা, কিংবা শাকওয়ালি বাতাসী। এই মানুষগুলোর সূত্রে স্বাতীর গল্পে উঠে আসে নগর-জনপদের খণ্ড খণ্ড বৈচিত্র-বিভিন্নতা।

স্বাতীর ভাষা-বয়ানে যেমন হারানো অনুভবের কথা, তেমনই মানুষ ও তার জীবনকে খুঁড়ে দেখার চেষ্টা মন্দাক্রান্তা সেনের কলকব্জা/ একটি গল্পের বই-এ (দে’জ, ২৫০.০০)। কখনও মানুষের জীবন ও তার পারিপার্শ্বিকের সংস্পর্শ, কখনও-বা মানুষের মাথার ভেতরকার সমান্তরাল পৃথিবীর গূঢ় বিবরণ। যেমন নাম-গল্পটিতে সদ্য ডাক্তার হয়ে গ্রামে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া নামের মেয়েটি: ‘তার এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামে ডাইন বলে পিটিয়ে মারা বন্ধ। তথাকথিত ডাইনের মনের কলকব্জার সাথে সাথে যারা তাকে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত, তাদেরও ওষুধ আছে তার হাতে। অঞ্চলের লোক মেয়ে-ডাক্তার ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। সে তাদের চোখে দেবী। সর্বরোগহারিণী।’

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement