হেম কানুনগো রচনাবলী, সম্পাদনা: স্বদেশরঞ্জন মণ্ডল। শিরোপা, ৭০০.০০
বিপ্লবের টানে মেডিক্যাল কলেজের পড়াশোনা কিংবা সরকারি আর্ট স্কুলের শিক্ষাক্রম, কোনওটাই সম্পূর্ণ করেননি মেদিনীপুরের অকুলীন (‘নিম্নবর্গ’?) পরিবারের সন্তান হেমচন্দ্র দাসকানুনগো (১৮৭১-১৯৫০), যিনি পরে স্বহস্তে নিজের নাম থেকে ‘চন্দ্র’ এবং ‘দাস’ দু’টি উপসর্গই ছেঁটে ফেলেছিলেন। ঘটি-বাটি বেচে তিনি প্রথমে লন্ডন, পরে প্যারিস গেলেন বোমা বানানো শিখতে। প্রথম যে-তিনটি বোমা দিয়ে বাংলায় বিপ্লব কাণ্ডের শুরু, তিনটিই তাঁর বানানো। প্রথমটি চন্দননগরের মেয়র-হত্যার জন্য, দ্বিতীয়টি কলকাতায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য পাঠানো বই-বোমা যেটির প্যাকেট খুললে কিংসফোর্ডের মৃত্যু অনিবার্য ছিল, আর তৃতীয়টি কিংসফোর্ডের জন্যই (তিনি তখন জেলা জজ) মজফ্ফরপুরে ক্ষুদিরামের বোমা। শেষ ঘটনাটির পর আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯০৯ সালে আন্দামানে দ্বীপ-চালান হয়ে যায় তাঁর। হেম কানুনগো মুক্তি পান ১৯২১ সালে।
১৩২৯ (১৯২২) সালের আশ্বিন থেকে ১৩৩৪ (১৯২৭) সালের মাঘ পর্যন্ত ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় তাঁর বিপ্লবী জীবনের ধারাবাহিক কাহিনি লেখেন হেম। সেই প্রবন্ধগুলিকে একত্র করে ১৯২৮ সালে কমলা বুক ডিপো বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা নামে বই বার করে। জীবনের শেষ দিকে হেম এই কিংবদন্তিসম বইখানির একটি পরিবর্ধিত সংস্করণের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে গিয়েছিলেন। এত দিন সেটি পড়ে ছিল অবহেলায়। পরিশ্রমী গবেষক স্বদেশরঞ্জন মণ্ডল সেই পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করে প্রকাশ করেছেন। এর জন্য গোটা বাঙালি সমাজ নিশ্চয়ই তাঁকে কুর্নিশ জানাবে। রচনাবলিতে এ ছাড়া রয়েছে এডোয়ার্ড বেলামির সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা অবলম্বনে হেম কানুনগোর অনাগত সুদিনের তরে বইটি। এখানে সমাজ, রাজনীতি, এমনকি নরনারীর যৌন সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর স্বচ্ছ চিন্তার সাহসিকতা অবাক করে। প্রতিলিপি সহ বেশ কিছু চিঠি এই রচনাবলির অমূল্য সম্পদ। হেমের আর একটি বড় পরিচয় হল, তিনি এক জন চিত্রশিল্পী। বেশ ওস্তাদি ঢঙে আঁকা কয়েকখানি দুর্লভ তৈলচিত্র সংগ্রহ করে ছেপেছেন সম্পাদক। শুধু তৈলচিত্রই নয়, রয়েছে হেমের নিজের তোলা অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী মৃণালিনীর আলোকচিত্রও। রয়েছে বেশ কিছু স্বরচিত কবিতা ও গান। তাঁর একটি রামপ্রসাদী প্যারডি আজকের দিনেও কারও কারও কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে:
‘দেশ বলে যারে বল মন
সে ত ত্রিশ কোটীর জেলখানা।
তফাত শুধু বুঝে দেখ মন, খাঁচায় আর চিড়িয়াখানা
(তার) এ ধারে যা ও ধারেও তা, মাঝখানেতে দেয়ালখানা।’
হেম জানাচ্ছেন, ১৯০২ সালের মাঝামাঝি নাগাদ তিনি ‘সিক্রেট সোসাইটি’ গঠনের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। লাঠি, তলোয়ার, কুস্তি, বক্সিং শেখানো হত সেখানে। ‘সভ্য শ্রেণিভুক্ত হতে হলে তলোয়ার সাক্ষ্য করে, গীতা ছুঁয়ে দীক্ষা নিতে হত।’ কিন্তু এর আগে ‘আমাদের কোনো মন্ত্র ছিল না, ধর্ম কিংবা ভগবানের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ ছিল না।’ এমনকি ১৯০৪ সালেও ‘যোগসাধনায় সিদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্তপুরুষ না হলে যে সহকারী নেতা হওয়ার, আর সাধনারত না হলে যে চেলা হওয়ার অধিকারী হতে পারে না, এ বিধান তখনও প্রচলিত হয়নি। নিষ্কাম কর্মের বড়াই করবার ফ্যাশন তখনও প্রচলিত হয়নি।’ সে-‘ফ্যাশন’ চালু করবার জন্য অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতাদের দায়ী করেছেন হেম: ‘অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও লোকের মনে গুপ্ত সমিতির আদর্শ শেকড় গাড়তে পারছে না’ দেখে ‘নেতারা ভাব প্রচারের সময়, ধর্মের ফোড়ন আর ভগবান, কালী, দুর্গাদির দোহাই দিতে শুরু করেছিলেন।’
ধর্ম-কেন্দ্রিক পরিবর্তন আনার বিপদ সম্বন্ধে অবহিত হেম খানিকটা আর্নল্ড টয়েন্বির ‘ধাক্কা আর প্রতিক্রিয়া’-তত্ত্বের ধাঁচে, কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি বস্তুবাদের গণ্ডির মধ্যে রেখে, ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেন: ‘বুদ্ধদেবের প্রচারিত জ্ঞানের আদর্শ... আমাদের সনাতন ধর্মের দেশে... যে শুধু ব্যর্থ হয়েছিল তা নয়, তার প্রবল প্রতিক্রিয়ার দাপটে দেশ আজও খোলা চোখে দিন-দুপুরে দুঃস্বপ্ন দেখছে জগৎ মিথ্যা।’ অতঃপর ‘সনাতন ধর্ম আর রীতিনীতির নৃশংস বন্ধন থেকে স্বাধীনতার এক অভূতপূর্ব আদর্শ দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব।’ কিন্তু ‘প্রতিক্রিয়ার ফলে তার পরিণাম যে কী নিদারুণ হয়েছে, আর কাউকে বলে দিতে হবে না।’ এরপর ধর্মের যুক্তিহীনতার বিরুদ্ধে আবার আঘাত হানে ‘রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত যুক্তিবাদ (Rationalistic movement) আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধর্ম-সম্পর্কবিহীন জনসাধারণের শিক্ষার আদর্শ (Secular mass movement)।’ কিন্তু ‘সেই আদর্শ অনুযায়ী ফল ফলতে না ফলতেই প্রচণ্ড বেগে প্রতিক্রিয়া এসে সব ওলটপালট করে দিয়েছে।’ দেশের মানুষকে ‘স্বাভাবিক অভাববোধের বদলে নিছক কাল্পনিক, নিতান্ত অবোধ্য একটি পদার্থের অভাব বোধ করতে শেখানো হয়েছে। সেই পারমার্থিক জিনিসটির নাম পরকালে মুক্তি বা নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ।’ বিশেষ করে বিবেকানন্দের বিদেশ-যাত্রা ও ‘বিশ্বজয়’-এর পর থেকে এই ভাবধারা প্রবল হয়ে উঠে বিপ্লবী আন্দোলনকে বিপথগামী করেছে: ‘অর্থাৎ, এখন সনাতন হিন্দু সভ্যতার উদ্ধার এবং হিন্দুধর্মের একাধিপত্য (শুধু ভারতে নয়, সমস্ত জগতে, বিশেষ করে য়ুরোপ ও আমেরিকাতে) স্থাপন করাই হলো উদ্দেশ্য, আর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাই হলো তার উপায়। এই বৃথা স্পর্ধার কথা বলতে বোধ হয় প্রথম শিখিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।’ এই বৃথা স্পর্ধার পরিণতিতে বিপ্লবী সমিতির আড্ডাতে কালীমূর্তি স্থাপন করে ‘ফুলচন্দন দিয়ে নিত্য পূজা করা হতো।’ তাঁরই হাতে-গড়া বিপ্লবী ‘ক্ষুদিরাম বলেছিল, আর যাই হোক, কালীর কৃপায় বেশ পাঁঠা খেতে মিলে; আর পাঁঠার লোভে বেশ ভক্ত জোটে।’ যোগসাধনা-করা নেতাদের ‘নাক-টেপা’ বিপ্লবী বলে ব্যঙ্গ করতে কসুর করেননি হেম।
অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী। হেম কানুনগো-র তোলা আলোকচিত্র, বই থেকে।
হিন্দু ধর্মের সঙ্গে বিপ্লববাদকে গুলিয়ে ফেলার এই সর্বনাশা ফেনোমেননটিকে রসায়নবিজ্ঞান-পটু হেম যত্ন করে ব্যাখ্যা করেন। স্বদেশপ্রীতির সঙ্গে, বিশেষত গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্ম খাপ খায় না, কেননা ‘স্বদেশপ্রীতির একমাত্র লক্ষ্য জাতীয়-শ্রী বা অভ্যুদয়। এটা সম্পূর্ণ ইহলৌকিক বাস্তব (materialistic) ব্যাপার। এই অভ্যুদয় নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর। বিজ্ঞান ধর্মের হেঁয়ালি ভেঙে দিয়েছে ও দিচ্ছে, তাই ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের ঝগড়া। অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক অভ্যুদয়ের সঙ্গে জাতীয় অভ্যুদয়েরও ঝগড়া। স্বদেশপ্রীতি আর ধর্ম, অন্য কথায় জাতীয় অভ্যুদয় (কিংবা ডেমক্রেসি) আর ধর্মতন্ত্র; এ দু’টি জিনিসের মধ্যে যে সম্বন্ধ, আলো আর আঁধারের মধ্যেও ঠিক সেই সম্বন্ধ বিদ্যমান। একটি থাকলে অন্যটি অসম্ভব।’ আজকের কাপালিক-আকীর্ণ ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে এই মুক্তমনের মানুষটিকে একটু ভিন্ন অর্থে বিপ্লবী বলে প্রণাম জানাই।
তবে স্বদেশরঞ্জনবাবুর কৃতিত্ব এতটুকু খাটো না-করেও তাঁর সম্পাদকীয় গৃহিণীপনার অভাবের কথাটা না বললে অন্যায় হবে। বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা-র নতুন পরিবর্ধিত সংস্করণটি ঠিক কোন কোন জায়গায় নতুন ও পরিবর্ধিত, তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল। গ্রন্থে উল্লেখিত বহু মানুষের, বিশেষ করে এডোয়ার্ড বেলামি-র পরিচিতি দেওয়া ছিল আবশ্যিক। নির্ঘণ্টটি খুবই দায়সারা এবং ত্রুটিপূর্ণ। হেম কানুনগোর ‘পত্রাবলী’র শুরুতেই স্বদেশবাবুকে লেখা তাঁর শিক্ষকের আশীর্বাণীর লেখচিত্রের অনুপ্রবেশ খুবই দৃষ্টিকটু। ‘একবার বিদায় দে মা’ গান সম্বন্ধে বহু তথ্য দিলেও, এ বাবদে স্বদেশরঞ্জনবাবুর তথ্যানুসন্ধান অসম্পূর্ণ, মূল্যায়নও বেশ বিষয়ীগত। অন্য গবেষকদের হেম-গবেষণার অনুল্লেখও ত্রুটি বলেই গণ্য হবে।
এমন একটি অমূল্য তথ্য-সংবলিত বইয়ের যে পরে সংস্করণ হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। স্বদেশরঞ্জনবাবুর কাছে অনুরোধ, তিনি বিন্যাসপ্রণালী আমূল সংশোধন করে ইতিহাস রচনার আধুনিক পদ্ধতি-প্রকরণ মেনে বইটিকে একটু কসমোপলিটান ঢঙে ঢেলে সাজুন। হেম কানুনগোর মতো ব্যতিক্রমী বস্তুবাদী বিজ্ঞানমনস্ক বিপ্লবীর প্রতি এই বিলম্বিত শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্যোগ তবেই সার্থক হবে।
প্রথম আবির্ভাবেই নতুন প্রকাশক শিরোপা এমন একটি মূল্যবান বই নিবেদন করার জন্য সাধুবাদ পাবেন। তবে তাঁকে অঙ্গসৌষ্ঠবের পরিশীলন এবং প্রুফ-সংশোধনের ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে। এর কোনও সুলভ সংস্করণ বার করা কি সম্ভব?