পরিত্যক্ত বস্তু বা বর্জ্য পদার্থও একটি সভ্যতাকে চেনায়। বর্জ্য হল ভোগের উচ্ছিষ্ট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ভোগের চরিত্র পাল্টায়, তেমনই পরিবর্তিত হয় বর্জ্যের ধরনও। অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য সভ্যতার অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তোলে অনেক সময়। শহর বা শহরতলিতে এর দৃষ্টান্ত আমরা আজ অহরহই দেখতে পাই।
বর্জ্যের চরিত্র বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আজকের নগর-সভ্যতার চরিত্র উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন দিল্লিভিত্তিক শিল্পী ভিভান সুন্দরম। হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘ল্যান্ডফিল’। বড় মাপের ডিজিট্যাল প্রিন্ট, ফোটো মন্তাজ ও ভিডিয়ো ইনস্টলেশন নিয়ে করা এই প্রদর্শনীতে আজকের বিলাসবহুল ভোগবাদী সভ্যতার অন্তর্নিহিত শূন্যতাকে মেলে ধরেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে।
ভিভান সুন্দরম বরোদার এম.এস. বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের স্লেড স্কুলে প্রশিক্ষিত ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত একজন শিল্পী। ১৯৭২-এ করা তাঁর একটি চিত্রমালার শিরোনাম ছিল ‘দ্য ডিসক্রিট চার্ম অব দ্য বুর্জোয়াজি’। ১৯৭৬-৭৭-এ এঁকেছিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান এমার্জেন্সি’ নামে দুটি চিত্রমালা। তাঁর সমাজভাবনার অভিমুখ ধরা পড়ে এ সব কাজে। ১৯৯৮তে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রদর্শিত হয় তাঁর একটি বড় মাপের ইনস্টলেশন। ঊনবিংশ শতকে ভারতের নবজাগরণকে এখানে তিনি পুণর্নিমাণ করেন চিত্র-ভাস্কর্য-স্থাপত্য সমন্বিত ইনস্টলেশনের মাধ্যমে। তেমনই ২০০৩-এর ‘রি-টেক অমৃতা’ শীর্ষক আলোকচিত্রীয় কোলাজের প্রকল্পে ‘রেডিমেড’ ব্যবহার করে অমৃতা শেরগিলের শিল্পীজীবনের নানা দিকের উপর তিনি আলোকপাত করেছিলেন। এই রকম বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যতিক্রমী আঙ্গিক নিয়ে তিনি অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
সেই ধারাতেই আলোচ্য প্রদর্শনীটি তাঁর সৃজন প্রক্রিয়ার একটি নতুন দিক তুলে ধরেছে। এখানে রয়েছে প্রায় দশ বছর ধরে তৈরি ১২টি কাজ। অধিকাংশ কাজেরই মূল ভিত্তি আলোকচিত্র বা ফোটোগ্রাফি। তা থেকে বড় মাপের ডিজিটাল প্রিন্ট তৈরি করেছেন। আবার একাধিক চ্যানেল সমন্বিত ভিডিয়ো-ইনস্টলেশন তৈরি করেছেন। এই ভিডিয়োগুলিতে মন্তাজ ও অন্যান্য চলচ্চিত্র আঙ্গিকের কল্পনাদীপ্ত ব্যবহার অনেক সময়ই রূপকে কল্পরূপে অভিষিক্ত করেছে। বাস্তবের ভিতর এনেছে সুররিয়ালিজমের ব্যঞ্জনা। বিকল্প-রূপকল্প চর্চায় বহুমাত্রিকতার আভাস উঠে আসে তা থেকে।
ডিজিটাল প্রিন্টগুলি এক দিকে যেমন বর্জ্যের চরিত্রের আভাস দেয়, তার সামাজিক প্রেক্ষাপটকে উন্মোচিত করে, তেমনই চিত্রীয় নান্দনিকতার একটি বিশেষ ধরন গড়ে তোলে। ২০০৮ সালে করা ‘মেটাল বক্স’ শীর্ষক ডিজিটাল প্রিন্টের রচনাটিতে দেখা যায় অজস্র ভাঙা ধাতব পাত্র জড়ো হয়ে আছে। তার উপর পড়ে আছে বিশাল এক লৌহ-নির্মিত বাক্স। এই বর্জ্যের নিজস্ব কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠ নেই, কিন্তু শুধু অবস্থান দিয়েই তা সামাজিক বিশ্বচেতনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত নিয়ে আসে। তেমনই আয়তাকার সীমিত পরিসরে গড়ে ওঠা বর্ণিল বিন্যাস চিত্রীয়-নন্দনের বিশেষ এক ধরন তৈরি করে। এভাবেই ‘রিফ’, ‘ব্যারিকেড’, ‘মাস্টার প্ল্যান’, ‘প্রসপেক্ট’ ইত্যাদি ডিজিটাল প্রিন্টে এক দিকে বর্জ্যের বিপন্নতা, অন্য দিকে নগরের নির্মাণগত বাস্তবতার নানা বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা আভাসিত হয়।
‘দ্য ব্রিফ অ্যাসেনশন অব মরিয়ম হুসেন’ শীষর্ক ২ মিনিট ২০ সেকেন্ডের ভিডিয়োটি একটু অন্য ধরনের। শহরের অট্টালিকার উপরে একটি যুবক যেমন আপন ইচ্ছায় শূন্যে ভেসে উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার নেমে আসছে পূর্ব অবস্থানে। উচ্চাভিলাস ও তার ব্যর্থতার এক প্রতীকী আলেখ্য তৈরি হয়। ‘টার্নিং’ (১৪ মিনিট) ও ‘ট্র্যাকিং’ (১০ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড) শীর্ষক ভিডিয়ো ইনস্টলেশন দুটি কেবল মাত্র বর্জ্যের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সৃজনধর্মী এই দুটি ভিডিয়ো চলচ্চিত্র প্রকরণের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে নাগরিক জীবনের বহুমুখী বাস্তবতার কল্পরূপাত্মক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই সময়ের নিহিত শূন্যতাকে ব্যঞ্জিত করে তোলে। এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে দৃষ্টিননন্দন থ্রি-চ্যানেল ভিডিয়োটির শিরোনাম ‘ব্ল্যাক গোল্ড’। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য জুড়ে মেঝের উপর প্রক্ষিপ্ত হয় সমুদ্রজলে বর্জ্যের ঢেউ। কখনও তা উত্তাল হয়ে ওঠে। কখনও তা শান্ত। বর্জ্য যেন সভ্যতার বিরুদ্ধেই প্রতিশোধের ইঙ্গিত নিয়ে আসে।