চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

নির্মম পরিহাসে হিংসা ও সন্ত্রাসের বলি

সম্প্রতি গ্যাঞ্জেস গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত শাহাবুদ্দিন আহমেদ-এর একক প্রদর্শনী দেখলেন মৃণাল ঘোষকলকাতায় শিল্পকলা প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি যে ভারতের রাষ্ট্রপতি একজন শিল্পীর একক চিত্র-প্রদর্শনী উদ্বোধন করছেন। সে ঘটনাই ঘটল সম্প্রতি। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় উদ্ধোধন করলেন প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের ‘শান্তি’ শীর্ষক একক চিত্রপ্রদর্শনী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

কলকাতায় শিল্পকলা প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি যে ভারতের রাষ্ট্রপতি একজন শিল্পীর একক চিত্র-প্রদর্শনী উদ্বোধন করছেন। সে ঘটনাই ঘটল সম্প্রতি। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় উদ্ধোধন করলেন প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের ‘শান্তি’ শীর্ষক একক চিত্রপ্রদর্শনী। গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারির উদ্যোগে প্রদর্শনীর সূচনা হল আইসিসিআর-এ।

Advertisement

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি খুবই প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাষণ দিয়েছেন। শাহাবুদ্দিনের আবেগাপ্লুত বক্তৃতাটি শিল্পীর ছবির চরিত্র বুঝতেও অনেকটা সহায়ক হয়। আবেগই তাঁর সৃজনের মূল চাবিকাঠি। আবেগই তাঁর ছবির আঙ্গিককে নিয়ন্ত্রণ করে। রোমান্টিকতা সম্পর্কে কবি ওয়র্ডসওয়র্থের একটি উক্তি স্মরণ করা যায়। রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে একে তিনি বলেছিলেন ‘স্পনটেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিং’। শাহাবুদ্দিনের ছবি সম্পর্কেও এই অভিধাটি খুবই সুপ্রযোজ্য।

তাঁর ভাষণে শিল্পী ফরাসি চিত্রকর ইউজেন দ্যলাক্রোয়া-র কথা একবার উল্লেখ করেছিলেন। অস্টাদশ শতকের অন্তিম লগ্নে ইউরোপে শুরু হয়েছিল যে রোমান্টিকতার আন্দোলন দ্যলাক্রোয়া এরই একজন প্রতিনিধিস্থানীয় শিল্পী। ইংল্যান্ডে যেমন জে. এম. ডবল্যু. টার্নার। টার্নার মূলত নিসর্গের রূপকার আর দ্যলাক্রোয়া এঁকেছেন জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা, সংঘাত ও আন্দোলনের ছবি। তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ বা ‘দ্য ডেথ অব সারডানা প্যালাস’-এ অবয়ব বিন্যাসে দেখা যায় সংক্ষুব্ধতা ও তীব্র জঙ্গমতা। এই সংক্ষুব্ধতা ও গতি-চঞ্চলতা শাহাবুদ্দিনের ছবিরও অন্যতম বৈশিষ্ট। কিন্তু দ্যলাক্রোয়ার যেমন অবয়বগুলি স্বাভাবিকতায় স্থিত, শাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে তা নয়। শাহাবুদ্দিন তারও প্রায় দেড়-শতক পরের শিল্পী। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর ছবিতে রূপ ভেঙেছে। অভিব্যক্তিবাদী আবেগের তীব্রতাকে আত্মস্থ করেছেন তিনি। আত্মস্থ করেছেন রামকিঙ্করের গতি-চঞ্চলতাকেও।

Advertisement

শাহাবুদ্দিনের জন্ম ১৯৫০ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বস্ত এক সৈনিক হতে পেরেছিলেন বলে। প্লাটুন-কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের সময়ই অরণ্যে লুকিয়ে থাকার সময় ছবির প্রদর্শনীও করেছেন। যুদ্ধশেষে ১৯৭৪ সালে তিনি প্যারিসে চলে যান। প্রথমে শিক্ষার্থী হিসেবে। পরে সেখানেই থেকে যান স্থায়ীভাবে। মুজিবর রহমান তাঁকে বলেছিলেন, ‘প্যারিসে যাচ্ছিস, পিকাসোকে মাত করে দিবি’।

মুক্তিযুদ্ধ এই শিল্পীর সৃজনে নতুন দিশা এনেছিল। বাংলাদেশের চিত্রকলায় প্রথম প্রজন্মের প্রবক্তা যাঁরা জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবারিয়া প্রমুখ, তাঁদের ছবিতে স্বদেশচেতনার যে অভিমুখ ছিল বা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের শিল্পীরাও যে পথে চলছিলেন, শাহাবুদ্দিনের আঙ্গিক তা থেকে একেবারেই আলাদা। বাংলাদেশের আত্মার আর্তিকে তিনি প্রকাশ করেন অভিব্যক্তিবাদী জঙ্গমতায় বিশ্লিষ্ট করে। এই বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াতেই জেগে ওঠে গতি, আর্তি, মুক্তির তীব্র অভিপ্রায়। এ বারের প্রদর্শনীতে যে ৩৪-টি তেলরঙের ক্যানভাস দেখিয়েছেন তিনি তার প্রায় সবগুলিরই মূল বার্তা ‘..হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে’।

তিনটি ছবিকে পাশাপাশি রেখে এ বারের প্রদর্শনীর স্মারক তৈরি করা হয়েছে। তিনটিই অভিব্যক্তিবাদী মুখাবয়বচিত্র। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী ও মুজিবর রহমান।

এই তিন জনকেই শিল্পী মনে করেন আজকের জগতে শান্তির প্রতিভূ। ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে দু’জনকেই হতে হয়েছে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও সন্ত্রাসের বলি। যা শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথের চেতনাকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। আজ সারা বিশ্ব জুড়ে হিংসা ও শান্তির যে অন্তহীন সংঘাত, একেই শিল্পী রূপ দিয়েছেন তাঁর ছবিগুলিতে। তাঁর ছবির বিষয় প্রধানত মানুষ। মানুষের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিযাত্রা। প্রকৃতির অন্য কোনও উপাদান নেই বললেই চলে। সম্ভবত শুভ্রতা তাঁর কাছে শান্তির প্রতীক। চিত্রপটে উজ্জ্বল শুভ্র আলোকে তিনি দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। সেই প্রেক্ষাপটে প্রতিস্থাপিত হয় ছুটন্ত মানুষ। দ্রুত তুলির টানে বর্ণপুঞ্জ ছড়িয়ে দেন। রক্তের লালিমাকে বলা যায় তাঁর বর্ণ-পরিকল্পনার সম্বাদী সুর। রক্তের তেজে বা রক্তের বিচ্ছুরণে জেগে ওঠে শপথ—যা তাঁর কাছে শান্তির অভীপ্সা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement