বিবর্তিত: মহিষমর্দিনী দুর্গা। বৃহদীশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে সুব্রহ্মণ্য মন্দিরের প্রস্তরভাস্কর্য। তাঞ্জোর, তামিলনাড়ু
হিরোইক শাক্তিজ়ম/ দ্য কাল্ট অব দুর্গা ইন এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়ান কিংশিপ
বিহানী সরকার
৭৫ পাউন্ড
ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি মনোগ্রাফস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে দেবী দুর্গার সম্পর্ক এবং এই সূত্রে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত দুর্গার বিবর্তনের ইতিহাস এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। বস্তুত লেখিকা দুর্গার প্রাক্-ইতিহাস আরও আগে থেকে অনুসরণ করেছেন এবং তাঁর অনুসন্ধান শেষ-মধ্যযুগ পর্যন্ত ব্যাপ্ত। বইটির মূল প্রতিপাদ্য হল, কী ভাবে দুর্গা একটি দুরন্ত প্রকৃতির প্রান্তিক দেবী থেকে পরিবর্তনের নানা স্তর পার হয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য স্বীকৃতি অর্জন করলেন এবং আদর্শ রাজশক্তির প্রতীক হিসাবে গৃহীত হলেন। এর মধ্যে দুর্গাকে বৈষ্ণব, শৈব, তান্ত্রিক-বৌদ্ধ ও জৈন— এই সব সাম্প্রদায়িক পরিচয় অতিক্রম করতে হয়েছিল। একই সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেও একটি বড় পালাবদল ঘটে গিয়েছিল; সাম্রাজ্য ভেঙে আঞ্চলিক রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ঘটেছিল।
বইটির প্রথমাংশের কয়েকটি অধ্যায়ে লেখিকা দেখিয়েছেন কী ভাবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে— যখন গুপ্ত সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার তুঙ্গে— একক দেবী দুর্গা অস্পষ্ট সূচনা থেকে ক্রমশ মর্যাদা লাভ করেন। নানা উপাদানে গঠিত যৌগিক দেবী দুর্গার অন্যতম উৎস, লেখিকার মতে, তৃতীয় শতকের কৃষ্ণবর্ণা, পীত-বসন ও ময়ূরপুচ্ছ শোভিতা, বৈষ্ণবদের উপাস্য মৃত্যুর দেবী নিদ্রা-কালরাত্রি, যিনি বিপদভঞ্জনের উদ্দেশ্যে পূজিতা হতেন। পঞ্চম শতাব্দী থেকে শৈবধর্ম এই অপেক্ষাকৃত অপরিচিতা দেবীকে গ্রহণ করে তাঁর নানা পরিবর্তন সাধন করতে থাকে এবং ক্রমে তিনি শিবের সহধর্মিণী পার্বতীর সঙ্গে সমরূপত্ব লাভ করেন। এর পর, প্রধানত শৈব পুরাণকাহিনিগুলির মধ্যস্থতায়, দুর্গা শৈব-পরিবারে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেন এবং সাম্রাজ্যের প্রতীকরূপে দেবসেনাপতি স্কন্দকে স্থানচ্যুত করে তাঁর স্থান অধিকার করেন। এই সময় ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসান হয়ে নানান নতুন রাজবংশের উত্থান ঘটছে। দুর্গা এই সব রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং তাঁদের আত্মপরিচয়মূলক প্রচারপত্রে বৈধ শাসনাধিকারের প্রতীকরূপে বিশেষ প্রাধান্য অর্জন করেন। লেখিকার মতে, ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে শাক্ত-বীরধর্ম সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই সময়কার রাজবংশগুলি— যেমন চালুক্য রাজারা— তাদের কুলদেবতা স্কন্দের পরিবর্তে দুর্গাকে রাজবংশের ও রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করে।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে লেখিকা এই সব নতুন রাজবংশের প্রেক্ষিতে দুর্গার বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করেছেন, যখন দুর্গা আঞ্চলিক রাষ্ট্রের প্রতীক স্থানীয় দেবীদের সংশ্লেষণের দ্বারা নিজের অঙ্গীভূত করে নিচ্ছেন। লেখিকা মনে করিয়ে দিয়েছেন, পূর্বতন সাম্রাজ্যগুলির তুলনায় এই নতুন রাষ্ট্রগুলির চরিত্রের একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। গুপ্ত রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় আটবিক রাজ্যগুলিকে— অর্থাৎ অরণ্যচারী উপজাতিগোষ্ঠীসমূহ উত্তর ও মধ্য ভারতের নানা অঞ্চলে যে সব রাজত্ব স্থাপন করেছিল সেগুলি—অধিগ্রহণ করে ভারতীয় রাজনীতির মূল স্রোতের অংশ করে নেন। এর ফলে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর, উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে যে সব আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে তাদের প্রকৃতি ও গঠন সাম্রাজ্যগুলির চেয়ে এতটাই আলাদা হয়ে যায় যে এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে লেখিকা একটি ‘নতুন পৃথিবী’ বলে বর্ণনা করেছেন। যে সব স্থানীয় দেবীরা এই আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলিকে রাজনৈতিক বৈধতা প্রদান করে তাদের রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক বলে গণ্য হন, তাঁরা তাঁদের নাম, প্রতিমা-লক্ষণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও দুর্গার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গারই নানা রূপ বলে পরিচিতি পান। লেখিকা চৌলুক্যদের কণ্টেশ্বরী, মল্লদের মানেশ্বরী, চাহমানদের আশাপুরী, নাগ ও কাকতীয়দের দন্তেশ্বরী— এ রকম ছ’টি উদাহরণ বিশ্লেষণ করেছেন। লেখিকা দেখিয়েছেন, পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী এই সব রাজবংশের কুলদেবীরা বংশের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রথম রাজকার্যে নিয়োজিত করেন এবং রাজবংশ ও রাষ্ট্রকে বৈধতা ও প্রতিরক্ষা প্রদান করেন। লেখিকা তাঁর সময়সীমা থেকে অনেকটা সরে এসে বাংলা গোসানীমঙ্গল গ্রন্থের আলোচনা করেছেন, যেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কামতা (কোচবিহার ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল) রাজবংশের প্রথম পুরুষ কামতেশ্বর কী ভাবে দেবী চণ্ডীর প্রসাদে— যিনি কামতা রাজবংশের কুলদেবী গোসানী-কামতেশ্বরী রূপে প্রতীয়মানা হন— রাজত্ব লাভ করেন এবং একটি নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাহিনিটি পঞ্চদশ শতাব্দীতেই প্রচলিত ছিল, যদিও তা সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীতে গ্রন্থবদ্ধ হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে দুর্গা-কেন্দ্রিক দেবীপূজার সম্পর্কের পরম্পরার যে সূত্রপাত আদি-মধ্যযুগে হয়েছিল তা আধুনিক যুগের প্রারম্ভ পর্যন্ত প্রবহমান ছিল।
গ্রন্থের শেষাংশের দুটি অধ্যায়ে লেখিকা দেবীপূজা সংক্রান্ত বিশ্বাস ও প্রতীকী সম্পর্কগুলি কী করে সার্বভৌম রাজশক্তির ধারণাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল তা আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, এই ধারণাটির রক্ষণে ও প্রচারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল নবরাত্র উৎসব। লেখিকা দেখিয়েছেন কী ভাবে গুপ্তযুগের একটি অখ্যাত বৈষ্ণব উৎসব হিসাবে শুরু করে নবরাত্র একটি ভারতব্যাপী ব্রাহ্মণ্য শারদোৎসবে রূপান্তরিত হল এবং যার বাৎসরিক পুনরাবৃত্তি সর্বসাধারণের চোখে রাজশক্তির সঙ্গে দেবী দুর্গার সম্পর্ককে চূড়ান্ত বৈধতা দান করল। এই সম্পর্ক মূলত তিনটি বিশ্বাসের উপর স্থাপিত ছিল। প্রথম, দেবীশক্তিই রাজাকে তাঁর রাজকীয় কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করেন। দ্বিতীয়, যুদ্ধে পরাজিত হলে দেবীই রাজাকে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারেন। তৃতীয়, যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে দেবীর উপাসনা অপরিহার্য। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে এই ভাবেই যুদ্ধের দেবী দুর্গার সঙ্গে বীরধর্মের প্রতীক ক্ষত্রিয় রাজার সম্পর্ক নির্ধারিত ও আবর্তিত হয়েছে।
আলোচ্য গ্রন্থটির বিষয়বস্তু বহু-বিস্তৃত ও জটিল। স্বল্প পরিসরে লেখিকার তথ্য ও যুক্তির বিন্যাসের সামান্য কিছুই উপস্থাপিত করা গেল। দুর্গাকে আমরা শেষ পর্যন্ত যে রূপে পাই তা অনেক ব্রাহ্মণ্য রূপকল্পনা ও আঞ্চলিক দেবীর সমাহার, কিন্তু তাঁর সিংহবাহিনী মূর্তিটি কোথা থেকে এল? মথুরায় প্রাপ্ত কুষাণযুগের মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার (লেখিকার ভাষায় প্রাক্-দুর্গা) মূর্তিগুলিই দুর্গার এই বিশেষ প্রতিমা-কল্পনার প্রথম নিদর্শন। লেখিকা দেখিয়েছেন, এই মূর্তির উপর পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সিংহবাহিনী, যুদ্ধ ও মাতৃত্ব-প্রজননের দেবী নানার গভীর প্রভাব পড়েছিল। হিন্দুত্ববাদীরা জেনে খুশি হবেন না, দুর্গার সর্বাধিক পরিচিত রূপটির উপর এক ‘বিদেশি’ দেবীর প্রভাব অনস্বীকার্য।
রাজশক্তিকে বৈধতা প্রদান করতে এবং রাজাকে বীরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে একজন দেবীরই প্রয়োজন হল কেন? এই যে দেবীকে নানা রূপে দেখি, আবার তাঁরা সকলেই দুর্গার প্রতিরূপ— এই দেবী কি মূলত এক না অনেক? এ রকম অনেক প্রাথমিক প্রশ্ন লেখিকা উত্থাপিত করেছেন এবং তার উত্তর দিয়েছেন। পাঠক পড়ে নেবেন।
রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে দেব-দেবীর সম্পর্কের বিষয়টি নতুন নয়। এ নিয়ে আগে বিক্ষিপ্ত গবেষণা হয়েছে। কিন্তু একটি বিশেষ দেবী কী করে বিবিধ রাজবংশের কুলদেবী হিসাবে রাষ্ট্রশক্তিকে প্রভাবিত করেছিলেন সে বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ এই প্রথম। রাজনীতি এবং ধর্মের ইতিহাস — এই দ্বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকেই গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম। বইটির অন্যতম প্রধান সম্পদ তার বিচিত্র ও বহু-বিস্তৃত প্রাথমিক তথ্যসূত্র। তথ্যের সন্ধানে লেখিকা শিলালেখ-তাম্রশাসন থেকে সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্য মন্থন করেছেন। এমনকী, প্রাসঙ্গিক হলে, অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত বাংলা বইও যে তাঁর গবেষণাকক্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার পরিচয় আগে দিয়েছি।
সমালোচনার স্থান বিশেষ নেই। তবু দু’একটি সমস্যার কথা জানাই। ব্রাহ্মণ্য চিন্তায় দেবীর ধারণার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটে দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থে। লেখিকা দেবীমাহাত্ম্য-এর সাক্ষ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। টমাস কবার্ন, যিনি দেবীমাহাত্ম্য নিয়ে প্রামাণ্য গবেষণা করেছেন, মনে করেন এটি আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। লেখিকা মনে করেন অষ্টম শতকে। জানি, এই জাতীয় গ্রন্থের ঠিক কালনির্ণয় দুরূহ; দু’এক শতাব্দীর ব্যবধানে তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসান ঘটেছে; অষ্টম শতকে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলি সুনির্দিষ্ট রূপ পেয়েছে। কাজেই এই সময়সীমা লেখিকার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেখিকার গ্রন্থপঞ্জিতে কবার্নের উল্লেখ আছে, কিন্তু দেবীমাহাত্ম্য-এর রচনাকাল নিয়ে তিনি কেন ভিন্ন মত পোষণ করেন তার ব্যাখ্যা কোথাও দেননি।
ক্লাসিক/ ক্লাসিকাল, সিভিলাইজেশন/ সিভিলাইজেশনাল— এই শব্দদুটি লেখিকা বারংবার ব্যবহার করেছেন। দুটি শব্দেরই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও ব্যঞ্জনা আছে। প্রাগাধুনিক ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কী অর্থে এই শব্দদুটি লেখিকা প্রয়োগ করেছেন তা নিয়ে একটু সংশয় থেকে যায়। সভ্যতার সঙ্কটমুহূর্তে দেবীর প্রয়োজন বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়। কিন্তু এই সঙ্কটের স্বরূপটি কী তা লেখিকা বুঝিয়ে বলেননি। ধরে নিয়েছেন, পাঠক জানেন। পাঠক-পাঠিকাকে সর্বজ্ঞ ভাবলে তাঁরা খুশিই হন। আমার কিন্তু একটু অস্বস্তি থেকে গেল।
এহ বাহ্য। প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও গভীর মননসমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি বিশেষজ্ঞদের চাহিদা পূরণ করবে, সাধারণ পাঠকের কৌতূহলও চরিতার্থ করবে।