অজিতেশ
সম্পাদক: ভবেশ দাস
৭০০.০০
পরম্পরা
তখন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আইপিটিএ-র হয়ে গ্রামে নাটক করতে যেতেন, তেমনই এক বারের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে: ‘‘আমরা তো খুব গরমগরম লেকচার দিচ্ছি। দেখি একটা লোক সমানে আমার পায়ের দিকে চেয়ে আছে। জিগ্যেস করলাম, কী দেখছেন? আমার পায়ের একটা আঙুল একটু কেটে গিয়েছিল। লোকটা সেইদিকে দেখিয়ে বলল, বাবু, ‘কেটেকুটে গেলে আমরা গাবগাছের আঠা লাগাই; আপনারা কী লাগান?’... ব্যাস, বুঝে গেলাম, এতক্ষণ যা বলেছি, সব ফালতু। লোকটাকে আমি চিনি-ই না।’’
অপরিচয়ের চোখ দিয়ে যিনি চারপাশের মানুষজনকে চেনার চেষ্টা করতেন, সে ভাবেই নিজের কাজের জায়গা, বাসস্থান, পথঘাট, দোকানপাটকে জানতে চাইতেন, বুঝতে চাইতেন, আর সেই শেখাটাকেই শিল্পে প্রয়োগ করতে চাইতেন, তাঁর নামই অজিতেশ। ভবেশ দাশ সম্পাদিত এ-বইয়ে তাঁর ভিতরের ‘ব্যক্তিগত মানুষেরও দেখা পাব’, মনে হয়েছে শঙ্খ ঘোষের, সূচনাকথা-য় লিখেছেনও সে কথা। বইটির শুরুতেই সংকলিত হয়েছে অজিতেশের কবিতাবলি: ‘সংরক্ত চিত্রমালা’। আসলে ‘অনেকগুলো সত্তা একসঙ্গে কাজ করেছে অজিতেশের ভিতরে। একদিকে অভিনেতা-নির্দেশক-নাটককার; আর একদিকে কবিসত্তা।’ সম্পাদকের কথা-য় তা কবুল করার সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবেই গোটা বইটিকে সাজিয়েছেন ভবেশবাবু। অজিতেশের সেই বিভিন্ন সত্তা নিয়ে লিখেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত পবিত্র সরকার শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভাস চক্রবর্তী অশোক মুখোপাধ্যায় দেবাশিস মজুমদার প্রভাতকুমার দাস প্রমুখ। মায়া ঘোষ বা রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিস্মৃতিতেও অজিতেশের এমন এক পরব্রতী মূর্তি জেগে ওঠে যার পরিচয় অনেকেরই অজানা। তাঁর এক বিস্তারিত অভিনব জীবনপঞ্জি প্রস্তুত করেছেন সম্পাদক। আছে তাঁকে নিয়ে আমাদের চর্চার পঞ্জিও। সর্বোপরি তাঁর রচনাদির প্রাসঙ্গিক তথ্য। এই সূত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বতন্ত্র রচনা অন্তর্ভুক্ত না হলেও অজিতেশ সম্পর্কে তাঁর জরুরি মন্তব্য সংকলিত করতে ভোলেননি সম্পাদক: ‘ওঁর অভিনয়ে যেটা আকর্ষণীয় ছিল, সেটা আমার আইডল শিশিরকুমারেরও ছিল, তা হল অভিনয়ে এতটা এনার্জি, প্যাশান জেনারেট করতে পারার ক্ষমতা।’
শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্ত সত্ত্বেও অজিতেশ কোথায় স্বতন্ত্র এবং স্বনির্ভর ছিলেন তা জানার জন্যেই এ-বইয়ের পাতা ওল্টাতে হবে বার বার।
উত্তরবঙ্গের আলোকে ডুয়ার্স
লেখক: রণজিৎ দেব
৩০০.০০
দেশ প্রকাশন
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, বইটির লেখক রণজিৎ দেব জীবনের একটা সময় কাটিয়েছেন ডুয়ার্সের অরণ্যভূমিতে। ওখানকার জনজাতিদের নাচ-গান, আচার-আচরণ, বেঁচে থাকার, জীবন-চর্চার হাল-হকিকত তাঁর আষ্টেপৃষ্ঠে। সেই উপলব্ধি এবং গবেষণাই এই বইয়ে প্রতিভাত হয়েছে। ডুয়ার্স বলতে আমরা বুঝি, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির একটি অংশ, যা এক সময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, পরে ইংরেজরা ওই জঙ্গল কেটে চা-বাগান গড়ে। ফলে ওখানকার আদিম জনজাতি, যেমন লেপচা, টোটো, মেচ, রাভা, ডুকপা, লিম্বু, ভুটিয়া, ধীমল যাঁরা ঝুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরা হয়ে যান উদ্বাস্তু। আর চা-বাগান গড়ে তোলার সময় সাঁওতাল পরগনা, রাঁচি, লোহারডাগা, ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম, কোরাপুট ও মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ‘কুলি’ হিসেবে যাঁদের আনা হয়েছিল, যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ প্রভৃতি, তাঁরা চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থিতু হন ওই অঞ্চলে। এই সমস্ত জনজাতির জীবনযাত্রার প্রতিফলনে নানা রঙে আবৃত হয়েছে ডুয়ার্সের চা-বাগান ও অরণ্যাঞ্চল। ওই অঞ্চলে তথাকথিত ‘বহিরাগত’দের যেমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তেমনই আদি জনজাতীয়দেরও আলাদা সংস্কৃতি ছিল। সেই সংস্কৃতি এবং জীবন পরিচয়, বাঁচার সংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, সাধ-আহ্লাদ, আন্দোলন লেখক তাঁর ২৭২ পৃষ্ঠার বইটিতে বিশেষ ভাবে তুলে ধরেছেন। আশা করা যায় লেখকের এই প্রয়াস পাঠকমহলে সমাদৃত হবে।
বাংলা উপন্যাস/ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
লেখক: অলোক রায়
৩৫০ .০০
অক্ষর প্রকাশনী
যদিও ভূমিকা-য় লিখেছেন অলোক রায় ‘বইটি আগাগোড়া পড়লে পাঠকের কাছে অস্পষ্ট থাকবে না যে, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস লেখার চেষ্টা করিনি...’, তবু তাঁর এ-বইতে ইতিহাস প্রচ্ছন্ন হয়ে আছেই, আর তা আমাদের উপন্যাসের শিল্পরূপের ইতিহাস, বাঙালির সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। তিনি সিলেবাস-পাঠ্য সাহিত্যের ইতিহাস লেখেননি, তাঁর মতো মনস্বী সমালোচকের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। বইটির সূচনায় লিখেছেন ‘বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি’, সঙ্গে সঙ্গে এও জানাতে ভোলেননি যে বিশিষ্ট সমালোচকরা ‘বাংলা উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন, সাহিত্যবিচার হিসেবে সে আলোচনা মূল্যবান। কিন্তু বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস ঠিক কোথা থেকে শুরু করা হবে তা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছনো যায়নি।’ কেন পৌঁছনো যায়নি তার সম্ভাব্য কারণটিও লিখেছেন আলতো অথচ চকিত একটি মন্তব্যে: ‘উপন্যাস কাকে বলব তা নিয়ে মতান্তরের অবকাশ আছে।’
বাংলা উপন্যাসের আদি যুগ থেকে বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাঁর নির্বাচিত ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস নিয়ে যে ভাবে তিনি আলোচনা করেছেন, তাতে শুধু গবেষকরাই নন, সাহিত্যের মনস্ক পাঠকরাও উপকৃত হবেন। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ বা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আছেন বিতর্কিত শরৎচন্দ্রও, তাঁর উপন্যাসভাবনা নিয়ে অলোকবাবু লিখেছেন ‘‘শরৎচন্দ্রের যে-রচনাগুলি বাঙালি পাঠকসমাজের সবচেয়ে বেশি প্রিয়, শরৎচন্দ্র নিজে কিন্তু সেগুলিকে কখনো উপন্যাস বা গল্পের ‘আদর্শ’ মনে করেননি।’’ এ ভাবেই সতীনাথ ভাদুড়ীর পাশে আলোচিত মণীন্দ্রলাল বসু আর তাঁর ‘রমলা’, সমরেশ বসু বা মহাশ্বেতা দেবীর পাশে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা অমলেন্দু চক্রবর্তী।