কবি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু
“কবি হবেন দ্রষ্টা, নিজেকে তিনি বানাবেন দ্রষ্টা। নিজেকে তিনি দ্রষ্টা বানাবেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের এক দীর্ঘ বিশাল আর সচেতন ভ্রষ্টতার ভিতর দিয়ে। সব রকমের প্রেম, কষ্ট এবং উন্মাদনার মধ্য দিয়ে। কবি নিজেকে খোঁজেন। নিজের ভিতরের সব বিষকে তিনি খরচ করে ফেলেন, রেখে দেন শুধু তাদের নির্যাস। অকথ্য অত্যাচার করেন নিজের উপর, যেখানে তাঁর সমস্ত বিশ্বাস প্রয়োজন, সমস্ত অমানুষিক ক্ষমতা, যেখানে তাঁকে হয়ে উঠতে হয় সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগী, বিশাল অপরাধী এবং অভিশপ্ত এক জন। আর, বিশাল পণ্ডিত। কেননা, তিনি পৌঁছতে পারেন অজানায়।” (চিঠি, আর্তুর র্যাঁবো) লিখেছিলেন র্যাঁবো, তাঁর শিক্ষক ইজ়ামবারকেও, আর একটি বিখ্যাত চিঠিতে— “আমি হলাম অন্য কেউ। কী দুরবস্থা সেই কাঠের টুকরোর, যে হঠাৎ দেখে, সে হয়ে উঠেছে বেহালা।”
নিজেকে অন্য কেউ করে তোলাটাই এক জন মানুষের কবি হয়ে ওঠা। এ বাংলায় ত্রিশ দশক যদি আধুনিক কবিতার মাইলফলক হয়, তার পরবর্তী প্রতিটি দশকেই, নিজেকে দ্রষ্টা তৈরি করতে কবিদের যে পরিশীলন, যে আত্মঘাত, যে দীর্ঘ পরিশ্রম, যা আমাদের দিয়েছে এক সারণি, অসংখ্য কবির। সেখানে রয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সত্যবদ্ধ অভিমান নিয়ে, তাঁর স্বীকারোক্তির কবিতার নবপ্রসূত ধারাবাহিকতা থেকে এক পারম্পর্যে চলে আসা জীবন বদলাবদলি নিয়ে... নানা চরিত্রের ভিড় হয়ে হারিয়ে যেতে। আছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় অল্প এলিমেন্টে কবিতা তৈরির আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে, কথ্য সহজতা নিয়ে। পিকাসো সম্পর্কে কথিত গল্প আছে, তিনি একটা দেশলাই কাঠি, একটা দেশলাই বাক্স আর একটা নুড়ি দিয়ে ফ্রাঁসোয়াজ় জ়িলো-কে বলতেন, কম্পোজ়িশন বানাও দেখি এই ক’টা জিনিস দিয়ে। তিনটি জিনিসেই তৈরি হত অসংখ্য শিল্প-চিত্রের সম্ভাবনা। আমাদের কাছে আছেন সেই শব্দ উদ্ভাবনের সম্রাট উৎপলকুমার বসুও। ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি... এই ‘চটি’ শব্দটির একদা অর্থ ছিল ছোট সরাইখানাও। ভাবলেই বাদামপাহাড়ের অনুষঙ্গ আসে মনে...।
জয় গোস্বামীর জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কলাম ‘গোঁসাইবাগান’-এর কথা মনে পড়ে। প্রতি সপ্তাহে চাতকের মতো চেয়ে থাকা, এক এক সংখ্যায় এক এক কবির কবিতার উপরে আলো ফেলা... খুব দৈনন্দিন, সাধারণ জায়গা থেকে শুরু করা নিচু কণ্ঠ এক একটি লেখা দেখতে দেখতে কবিতার প্রতি শব্দের ভিতরে সেঁধোয়, পড়ে নেয় প্রতি অনুষঙ্গ, আলোকিত করে এক কবির কবিতাকে... তার প্রতিটি খাঁজখোঁজ, বাঁক আর তরঙ্গকে। এর মধ্যে উৎপলকুমার বসুকে নিয়ে একাধিক লেখা হয়েছিল। তা-ই আমরা পেয়ে যাব এই পুরী সিরিজের কবি বইটিতে।
জয়ের সুনীল
জয়ের সুভাষ
পুরী সিরিজের কবি
জয় গোস্বামী
১৫০.০০, ১০০.০০ ও ১৫০.০০
দে’জ পাবলিশিং
বাকি বই দু’টি ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর কবিকৃতি দুই-ই মিলিয়ে দিয়ে লেখা। আর কোথাও যেন ব্যক্তি আর কবির সীমারেখাও মুছে যেতে থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়— দুই স্তম্ভকে নিয়ে কবি জয়ের লেখার এক একটি সঙ্কলন, আবার যা অনায়াসেই কবিতা-দর্শনের কপিবুক। একই সঙ্গে অগ্রজ কবিকে তরুণ কবি কী ভাবে দেখেন, দেখবেন, দেখা উচিত, তার থেকে কী কী শেখাও উচিত, তার এক নিরিখ পাই এই দুই বইতে। আর স্মৃতির উজ্জ্বলতায় অনন্য এগুলো, সে তো জানা কথাই। কী রসবোধে, আর কী মরমি অনুভবে এক একটি বই অসামান্য। চোখের কোণে সামান্য জল এনে দেওয়া আর ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলা একই সঙ্গে সাধ্য হয়েছে প্রায় ক্ষণে ক্ষণে। বিশেষত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে স্মৃতিকথনটিতে তাঁর জয়ের জন্য ভাড়া বাড়ি খুঁজে দেওয়ার পর্বটি এক অসামান্য লেখন। জীবন্ত, যেন অক্ষর থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে যে দেখেনি, সে-ও তাঁর কথা বলার সুর মালুম করে নেবে অনায়াসে। ফিল্মের চিত্রনাট্যের মতো দেখতে পাবেন ওই শ্বেতকেশ, আশ্চর্য নিজস্বতাময় মানুষটির চলাফেরা ও কথা বলা।
এক জন মানুষের কাজ তাঁর কাছে কতখানি, ‘প্রায়রিটি’ নামক বহুব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার না করেই তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় কোনও কোনও ঘটনায়। অতি যত্নে সে কাহিনিও বর্ণনা করেছেন জয় গোস্বামী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে রাতে কবিতা লিখতে হবে সেই সন্ধেতে ট্যাক্সি ড্রাইভারের অভব্য প্রত্যাখ্যান দেখেও তিনি চকিতে গরম হওয়া মাথাটি ঠান্ডা করে নেন কী ভাবে... সে ছবিটিও প্রায় যেন চোখে দেখা গেল এই লেখায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অপরিসীম ভদ্রতাবোধ এবং কাউকে তিরস্কার করতে চাওয়ার পর না করতে পারার অসহায়তা, অসামান্য সব ছোট ছোট গল্পে উঠে আসে। এ সব পাওয়ার জন্য কয়েক মাইল হাঁটতে পারেন পাঠক। বড় লেখকের, বড় কবির সঙ্গ করা অনুজপ্রতিম কবির লেখন এই কাজ করতে পারে। যাঁরা সঙ্গ পাননি কখনও, তাঁদের কাছে এ সব লেখা অমৃতস্বাদ।
রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, গরম স্টোভের উপরে বরফের টুকরো যে ভাবে গলে যায়, একটি কবিতা সেই ভাবেই গলতে গলতে নামবে। কবিতার এই আপাত-সারল্যের সঙ্গে তার গভীরতার কোনও দ্বৈরথ নেই। একই কথা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সম্বন্ধে খাটে। অতি জনপ্রিয় এই কবির কাব্যভাষা ছিল সরল, নিতান্ত সাধারণ।
““নিতান্ত সাধারণ” কথাটা সুভাষের ভাষা সম্পর্কে আমি বার বার ব্যবহার করে চলেছি। ভাষাকে এই “সাধারণ” করে রাখাটাই সুভাষের অসাধারণত্ব।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখার ভাষা নিয়ে বলেন জয়। বলেন তাঁর কাজের কথা। ব্যক্তিমানুষের কথার পাশাপাশি বয়ে যায় তাঁর নির্মাণের সচেতন কৃতির কথা। দেখতে-শুনতে যা অতি সামান্য কিছু উপাদানের সৃষ্টি। যেন স্লোগান, যেন সংবাদপত্রের শিরোনাম থেকে উঠে আসে এক উড়াল দেওয়া কবিতা, সুভাষের কলমে। সংবাদপত্রের শিরোনাম কি কবিতা হয়? সুভাষের লেখায় কিন্তু তা আসলেই কবিতা। কবিতা আর সংবাদের তফাত যে ভাবে লেখেন জয়, তাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবিতার সংজ্ঞাও। আর এখানেই আমাদের পাঠকবর্গের অতিপ্রাপ্তি।
“সত্যিকারের কবি যিনি, তিনি এক দিন ঠিকই বুঝতে পারেন, সংবাদ দেওয়ার কাজ নয় কবিতার— তার কাজ সংকেত করার। তাই ত আমরা কবিতার কাছে যাই। নইলে ত সংবাদ পত্র পাঠ করেই আমরা তুষ্ট হতে পারতাম, তাই না?” জয়ের সুভাষ সে অর্থে এক কবিতাজার্নালও তো বটে।
জয়ের সুনীল বইতে জয় সুনীলের কবিতা নিয়ে লিখলেন ‘পাগলে পাগলে খেলা’র মতো আশ্চর্য একটা লেখা, যা অযাচিত, অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে নিয়ে আসে উপাদান। এক শিশুকে গল্পকথার মধ্যে নিয়ে আসেন তিনি, যে জিজ্ঞাসা করে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনে, মেয়েটা কোথায় গানটা গাইছে? সেখানে দিন না রাত্তির?
অদ্ভুত ভাবে এক কবির লেখা কিছু লাইন (প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে আমার চতুর্থ ভাগ আত্মা ছুটে যায়/ প্রতিটি আত্মার সঙ্গে আমার নিজস্ব ট্রেন অসময় নিয়ে খেলা করে) নিয়ে যে লেখাটি তৈরি করে তুললেন জয়, তা অনবদ্য, গভীর ও বহুবিস্তারী। আর আমাদের চেনা সুনীলকে আমরা এত বেশি করে প্রেমের কবি, কৈশোরময় প্রেমের কবির তকমা এঁটে রেখেছি, কৃত্তিবাসী সেই অনুষঙ্গে বেঁধে, তাঁর প্রণয়প্রিয়তা, আড্ডাপ্রিয়তার অনুষঙ্গে বেঁধে রেখেছি, যে লেবেলগুলো ধুলোপড়া ও অস্বচ্ছ এখন। জয় তাদের ঘষে তুলে দিয়ে নিখিলেশ থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য চরিত্রের সঙ্গে জীবন বদলাবদলি করে নেওয়া সুনীলের কথা জানান। মৃত্যুচিহ্নিত কবিতার পথ, লাঞ্ছনা ও মারচিহ্নিত মানুষের সঙ্গে জীবন বদলে নেওয়া কবির কথা জানান। নতুন রূপে সুনীল যেন উঠে আসেন আমাদের সামনে।
কবিতার ভাষা নিয়ে এই তিনটি ক্ষুদ্রকায় বই যা বলে দেয়, তা শব্দ-আকাঙ্ক্ষায় ঝামরে ওঠা অনেক তরুণ-তরুণীর জন্য এক ধরনের আঁকড়ানোর জিনিস। কেননা এক কবি, যিনি নিজে কবিতা লিখে চলেছেন, তাঁর কলম যখন জনপ্রিয় সুনীল বা সুভাষের বিষয়ে লেখেন, তা তো নতুন করে সেই চেনা কবিকে খোঁজারই এক দিক। অন্য দিকে, আপাতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য বা বিরল দুরূহ উৎপলকুমার বসুকে তিনি যে ভাবে দেখেন ও দেখান, তা অন্য এক দিক খুলে দিতে থাকে ক্রমাগত। কী ভাবে উৎপলকুমার এক একটি শব্দ দিয়ে নিজের কবিতার মেজাজ তৈরি করেন, তা নন-অ্যাকাডেমিক ভাবেও উপস্থিত হয় পাঠকের সামনে। “মনে হয় সত্য-মিথ্যার যমজ জন্মের আগে গান ছিল,” এই দুরূহ পঙ্ক্তির দুরূহতাকেও অতিক্রম করেন জয়, প্রতিটি শব্দের অনুষঙ্গে হাজারটি শিল্পকথন তুলে এনে।
আবারও বুঝি আমরা যে, সাধারণ পাঠকের মনটিকে খুব ভাল বোঝা না থাকলে এত বেশি করে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কবিতাকে পেশ করা সম্ভব নয়। পাদপীঠ থেকে নেমে আসা এই জয় গোস্বামী আমাদের মহার্ঘ অগ্রজদের আমাদের কাছে উপহার দিয়েছেন এই বইগুলির মধ্য দিয়ে।
মনে পড়ছে, তিন দিন পর, ১০ নভেম্বর, কবি জয় গোস্বামীর জন্মদিন।