পুস্তক পরিচয় ১

নাম শুনে যেন ধর্ম বোঝা না যায়

মেয়ের নামে তার বাবা আর মা, দু’জনেরই অংশ থাকায় ক্লাসটিচার বুঝে উঠতে পারেননি। এবং, মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন। সে দিন ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে মেয়েটির হাতেখড়ি হল।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share:

মাদারিং আ মুসলিম

Advertisement

লেখক: নাজিয়া এরাম

৩৯৯.০০

Advertisement

জগরনট

এক বন্ধুর ছয় বছরের মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে জানতে চেয়েছিল, ‘আমি হিন্দু, না মুসলমান?’ কিছু ক্ষণের প্রশ্নোত্তরের পর জানা গেল, জিজ্ঞাসাটি তার নয়, কলকাতার দেড় শতাব্দী প্রাচীন মিশনারি স্কুলে তার ক্লাসটিচারের। মেয়ের নামে তার বাবা আর মা, দু’জনেরই অংশ থাকায় ক্লাসটিচার বুঝে উঠতে পারেননি। এবং, মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন। সে দিন ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে মেয়েটির হাতেখড়ি হল। আরও তেরো বছর থাকতে হবে এই স্কুলেই, অথবা এ রকমই কোনও স্কুলে— তাই খুব ইচ্ছে হলেও স্কুলের কাছে পাল্টা প্রশ্ন করেননি বন্ধুটি। জানতে চাননি, কী ভেবে একটা ছ’বছরের বাচ্চাকে এমন প্রশ্ন করতে পারেন এক শিক্ষিকা।

স্কুলের কাছে জবাবদিহি চাওয়া অর্থহীন হত। কারণ, এই ভারত নরেন্দ্র মোদীর। ভিতরের সাম্প্রদায়িকতাকে গোপন রাখার, জনসমক্ষে না আনার দায় এই ভারতের আর নেই। নাজিয়া এরাম এই ভারতেরই গল্প বলেছেন তাঁর বইটিতে। নাজিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত, সমাজের উচ্চবিত্ত অংশের নাগরিক। আর পাঁচ জন শিক্ষিত মানুষের মতো তাঁর কাছেও ধর্মীয় পরিচয় কখনও তাঁর আইডেন্টিটির— পরিচিতির— প্রধান চিহ্ন হয়নি। অথবা, সন্তানের জন্মের আগে অবধি হয়নি। নাজিয়া লিখছেন, ‘২০১৪ সালে যখন আমার মেয়ে, মায়রা, জন্মাল, তাকে কোলে নিয়ে বুঝতে পারলাম, এই ভারতে মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকার যে ভয়, তা আমার শিরদাঁড়া দিয়েও বইছে। মেয়ের এমন নাম দেওয়া উচিত হবে কি না, যাতে তার ধর্মীয় পরিচয় প্রকট হবে, সেই প্রশ্নটা ভাবিয়ে তুলল আমায়।’ এই সংশয় শুধু নাজিয়ার নয়। প্রায় সব মুসলমান অভিভাবকের, যাঁরা চান, সন্তানের মেলামেশার বৃত্ত যেন মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। এবং চান, ধর্মীয় পরিচয় যেন সেই মেলামেশায় বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

নাজিয়ার বই যাঁদের গল্প বলে, তাঁরা ‘পিপ্‌ল লাইক আস’— সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, বিত্তবান, শিক্ষিত। ভোপালের নবাববংশের এক উত্তরাধিকারী যেমন। ইন্‌দওরে একটি বোর্ডিং স্কুলে বাড়ির ছেলেদের পাঠানো তাঁদের পরিবারের রীতি। স্কুলটি তৈরি হয়েছিল তাঁদের পূর্বপুরুষদেরই অর্থসাহায্যে। সেই স্কুলের হস্টেল থেকেই এক দিন ছেলের ফোন আসে মা-র কাছে। ছেলে জানতে চায়, ‘মা, আমরা কি পাকিস্তানি?’ ‘আমরা কি সন্ত্রাসবাদী?’ হস্টেলের যে ডরমিটরিতে ছেলে থাকত, সেখানে সে-ই ছিল একমাত্র মুসলমান। স্তম্ভিত মা-বাবা যোগাযোগ করলেন স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে। আশ্বাস দিলেন তিনি, কিন্তু পরিস্থিতি বদলাল না। শেষ অবধি ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হল ভোপালে।

গল্প সেখানে ফুরোয় না। ভোপালের স্কুলের ক্লাসে দুটো সেকশন। ইংরেজি আর হিন্দির পর তৃতীয় ভাষা হিসেবে যারা সংস্কৃত প়ড়ে, তাদের একটা সেকশন, আর উর্দুর ছাত্রদের আর একটা। খাতায়কলমে ধর্মের ভাগ নেই, কিন্তু মুসলমান ছাত্ররাই যেহেতু উর্দু পড়ে, ফলে সেকশনের এই ভাগ শেষ অবধি ধর্মের বিভাজনই হয়ে দাঁড়ায়। নাজিয়া জানাচ্ছেন, এটা শুধু এই স্কুলেরই ছবি নয়, দেশের প্রায় সব হিন্দি-উর্দুভাষী অঞ্চলে যে স্কুলেই মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা যথেষ্ট, সেখানেই এই ভাগ। এবং, শুধু ধর্মীয় পরিচয়েই আটকে থাকে না এই বিভাজন। অবধারিত ভাবেই মুসলমান ছাত্রদের সেকশনটি পরিচিত হয় ‘বাজে ছেলেদের ক্লাস’ হিসেবে। শিক্ষকরা এড়িয়ে চলতে চান, অন্য সেকশনের ছাত্ররাও মেশে না। তৈরি হতে থাকে মুসলমানদের ‘ঘেটো’। স্কুলের পরিসরেই।

লেখার গোড়ায় যে বন্ধুর মেয়ের কথা বলেছিলাম, প্রথম দিন বাংলার ক্লাসে রোলকল করতে গিয়ে তার নামে দিদিমণি থমকে দাঁড়ান। বলেন, এই ক্লাসে কেন? তুমি তো হিন্দি ক্লাসে যাবে। ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়েটি উত্তর দেয়, না আমি এই ক্লাসেই— আমি বাঙালি। এই ঘটনা অবশ্য আর অবাক করে না তার মা-বাবকে। মেয়ের মা সারা জীবন বহু বিস্ময়ের কারণ হয়েছে— ‘ও মা, তুমি মুসলমান। কথা বলে একদম বাঙালি মনে হয়।’

ইংরেজির শিক্ষক আসমা রিজওয়ান তাঁর ছেলে সমীরের গল্প বলেছেন। ভাল ছাত্র, তাই ‘বাজে ছেলেদের ক্লাসে’ যেতে চায়নি সমীর। স্কুলে উর্দুর বদলে সংস্কৃত পড়েছিল। দারুণ রেজাল্ট করে ভর্তি হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ভিন শহরের কলেজ। সেখানে একটা ঠিকানার প্রমাণপত্র দরকার হওয়ায় সমীর দ্বারস্থ হয়েছিল কলেজের ডিনের। অন্য ছাত্ররা যাঁর থেকেই এই প্রমাণপত্র পায়। সমীরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ডিন। বলেছিলেন, তুমি যে সন্ত্রাসবাদী নও, সেটা না জেনে ঠিকানার প্রমাণপত্র দিই কী করে?

মাদারিং আ মুসলিম-এ এমন হরেক আখ্যান। উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, সুপ্রতিষ্ঠিত শহুরে মুসলমানদেরও কী ভাবে তাড়া করে ফিরছে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়, তার কিস্সা। হাইকোর্টের এক বিচারকের মেয়ে যেমন জানিয়েছে, স্কুলে এক সহপাঠী তাকে পাশে বসতে মানা করে দিয়েছিল, সে মুসলমান বলে। এক তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী-দম্পতি বাড়ি ফিরে জেনেছিলেন, ছেলের এক সহপাঠীর মা তাকে বলে দিয়েছে, সে যেন মুসলমানের টিফিন বাক্স থেকে ভুলেও কিছু না খায়— নিশ্চয়ই গরু খাইয়ে দেবে। দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত পাড়ায় পাঁচ বছরের আজানিয়া শাহ রাতে ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠেছিল, ‘মুসলমানরা আসছে... পালাও... ওরা আমাদের খুন করবে।’

আর, এই আখ্যানগুলোই পাল্টে দিতে থাকে মুসলমান মা-বাবাদের। বেঙ্গালুরুর এক দম্পতি ইদের দিন পাঁচ বছরের ছেলেকে নতুন কুর্তা পাজামা পরে নীচে যেতে দিতে পারেননি। হাফপ্যান্ট-টিশার্টের ‘স্বাভাবিক’ পরিচ্ছদে যেতে হয়েছিল তাকে। অনেক কষ্টে একটা ভাল আবাসনে ফ্ল্যাট ভাড়া পেয়েছেন তাঁরা— যদি সবাই তাঁদের মুসলমান পরিচিতি জেনে যায়, এই আবাসনও যে ছাড়তে হবে না, সেই ভরসা ছিল না তাঁদের। আর এক মা প্রবল বকেছিলেন ছেলেকে। বারো বছরের ছেলে আয়ান তার পড়শি সমবয়সী করনের সঙ্গে এক্সবক্স-এ ভিডিয়ো গেম খেলছিল। করন উচ্চৈঃস্বরে প্রশংসা করে আয়ানের— ‘আরে ভাই, বোম ফেলায় তুই তো এক্সপার্ট হয়ে গেছিস!’ ভিডিয়ো গেমের বোমা, তবু বুকে শেল বেঁধে মায়ের। বন্ধু চলে গেলে ছেলেকে ডেকে বলে দেন, এই সব খেলা আর নয়। কোনও দিন যেন না শুনতে হয় তুমি বোমা মারায়, গুলি চালানোয় এক্সপার্ট। ছেলেমেয়ে কাদের সঙ্গে মিশছে, নিয়মিত তার ওপর নজরদারি চলে।

প্রতি দিন নিজভূমে পরবাসীর জীবন যাপন করা কাকে বলে, অথবা পাকিস্তানি নই, আমি আকণ্ঠ ভারতীয়, এই কথাটা অনিঃশেষ বলে চলতে কেমন লাগে— ভারতীয় মুসলমানরা জানেন। যাঁরা মুসলমান নন, কোনও মুসলমান পরিবারের অন্দরমহল যাঁদের কখনও দেখে ওঠা হয়নি, এই কথাগুলো তাঁদের আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন। তাঁদের জানা দরকার, ঠিক কোন দেশ আমরা তৈরি করছি ভবিষ্যতের জন্য। সেই কারণেই নাজিয়া এরামের বইটি এই সময়ের ভারতের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অতিকথন ছাড়া, নাটকীয়তা ছাড়াও যে এই সময়ের বিপন্নতার ছবি ফুটিয়ে তোলা যায়, মাদারিং আ মুসলিম তার প্রমাণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement