সুন্দরবন ও নদীকথা
অনিমেষ সিংহ
৪০০.০০
ঋত
কথা সুন্দরবন
গৌতমকুমার দাস
২৫০.০০
সোপান
সুন্দরবনের পরত তিনটে: প্রকৃতি, পরিবর্তন, প্রয়োজনীয়তা। দু’দশক সুন্দরবনের খাসতালুকে থেকে তা উপলব্ধি করেছি। ব-দ্বীপ ও লবণাম্বু বনরাজি তত বিস্ময়কর মনে হয়নি, যতটা উত্তেজনা বাড়িয়েছে তার পরিবর্তনশীল বাস্তুতন্ত্র ও সমাজ-সংস্কৃতি। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার অববাহিকায় ভেসে আসা উপনদীর পলির স্তরে লবণাম্বু উদ্ভিদের সমারোহ অন্য ম্যানগ্রোভের তুলনায় এখানে খুব আলাদা নয়। বাঘ-কুমির বা সমুদ্রস্ফীতিতে লবণাক্ত জমির অবক্ষয় যেমন সুন্দরবনের চিরাচরিত চরিত্র, তেমনই বৈচিত্রময় তার জঙ্গল হাসিলের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের ইতিবৃত্ত এবং নবপ্রস্তর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ব-দ্বীপবাসীর সংঘর্ষময় জীবনযাত্রা। দুর্যোগে বাঁধের ভাঙন আগলানো, দারিদ্র, ভোটকালীন অন্তঃকলহ বা বাঘের উপদ্রব— সবই।
সুন্দরবনকে চিনতে তাই দরকার নদী-দ্বীপের সচিত্র ধারাবিবরণী; স্বতঃঅবক্ষয়ী ও পুনর্নির্মীয়মাণ দ্বীপপুঞ্জের ভূসংস্থানের বোধগম্যতা। সুন্দরবন ও নদীকথা বইয়ে এ সবই আছে, শুধু প্রতিটি মানচিত্রে যদি দিক্দর্শন ও ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক দেওয়া থাকত, তা হলে সুবিধে হত। বোঝা যায়, ব-দ্বীপ পরিচিতি প্রসঙ্গে কল্যাণ রুদ্রের কাজ লেখককে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে, তবু এত অনুপুঙ্খ কাজে নেপাল হিমালয়ের জল-পলি সমৃদ্ধ কোশী নদীর দু’কথা থাকলে নতুন তথ্যের সংযোজন হত। তবে এ বইয়ে অরণ্য প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র অতি সরলীকৃত। একই সমস্যা কথা সুন্দরবন বইয়ে। তবে গল্পচ্ছলে লেখকের সহজ প্রস্তাবনা ছাত্রছাত্রীদের ভাল লাগবে। তাঁকে সতর্ক হতে হবে যাতে ভুল তথ্য পরিবেশিত না হয়। যেমন রাজকাঁকড়াকে কাঁকড়া বলা ঠিক নয়। এও ঠিক নয় যে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে মাছ চাষের অন্তরায় বর্জ্য জলের ব্যাকটেরিয়া।
সুন্দরবনের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ভৌগোলিক অনন্যতা মন টানলেও জানা দরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তার প্রয়োজনীয়তা এবং অদূর ভবিষ্যতে সংস্কৃতি ও জীবিকার উপর পরিবর্তনের প্রভাব। তা যথেষ্ট জায়গা পায়নি বইয়ে। তবে, প্রান্তিক মানুষের কথ্যভাষা নিয়ে অনিমেষ সিংহের দীর্ঘ আলোচনা এবং লোকাচার নিয়ে গৌতমকুমার দাসের গল্পকথা হৃদয়গ্রাহী। আসলে অভিযোজন শুধু লবণাম্বু উদ্ভিদেই নয়, সমাজেও বর্তমান। বিস্তৃত আলোচনায় বোঝা যাবে, সুন্দরবনে সৌরশক্তির প্রচলন, কাটা-তেলের বিক্রি, পরিযায়ী শ্রমিকবৃত্তি, বা ধর্মান্তরকরণ পর্যন্ত সুন্দরবনের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত। অথচ কোনও বইয়েই এ সবের উল্লেখ নেই। পাই না মরিচঝাঁপির কথাও। বাদ পড়ে গেল হ্যামিল্টন সাহেবের গ্রামীণ সমবায় সমিতির গোড়াপত্তনের ইতিহাস, যার প্রভাব সুন্দরবনের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে বিকল্প কৃষিকাজে। মাছ ও মধুর সঙ্গে মানুষ শৈবাল ও কাঁকড়া চাষেও এখন যত্নশীল। চলছে নোনাজলে ভাসমান চাষ। সুন্দরবন নিয়ে আরও গভীর আলোচনা বাকি রয়ে গেল।