পুস্তক পরিচয় ১

মায়েদের কথা, মেয়েদের কথা

১৯৮৯-তে গ্রন্থিত কবিতা সিংহের মোমের তাজমহল উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে আছে ‘মাতামহী শিশিরকুমারী এবং জননী অন্নপূর্ণার শ্রীচরণকমলে নিবেদিত’। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশিরকুমারী। কে জানে, ও-কাহিনির কোনও দ্বিতীয় পর্ব ছিল কিনা কবিতার স্বপ্নে, যা লেখা হলে স্পষ্টতর হত, কেমন করে রাজবাড়ির আদরের দুলালি থেকে অন্নপূর্ণা পৌঁছলেন কবিতার মাতৃত্বে।

Advertisement

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০৭:৩৯
Share:

‘‘আমার জীবনের অনেকখানি, বোধহয় সবখানি জুড়েই জ্বলজ্বল করছে আমার মায়ের ছবি’’ (‘বিলু ও ছ-টি মরচেপড়া আলপিন’, পৃ ১৫)— এই বাক্যটির অন্তরেই কি নিহিত আছে কবিতা সিংহের সাহিত্যিক সৃজনের মর্মকথা? যে মা পথে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত শিশুর প্রাণ বাঁচাতে ছুটে যেতেন, মেয়েকে বলতেন, গদ্য হল পাহাড় থেকে নেমে আসা ধ্বসের মতো, তাকে বাছাই করা চলে না, নির্বিচারে পড়তে হয়।

Advertisement

১৯৮৯-তে গ্রন্থিত কবিতা সিংহের মোমের তাজমহল উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে আছে ‘মাতামহী শিশিরকুমারী এবং জননী অন্নপূর্ণার শ্রীচরণকমলে নিবেদিত’। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশিরকুমারী। কে জানে, ও-কাহিনির কোনও দ্বিতীয় পর্ব ছিল কিনা কবিতার স্বপ্নে, যা লেখা হলে স্পষ্টতর হত, কেমন করে রাজবাড়ির আদরের দুলালি থেকে অন্নপূর্ণা পৌঁছলেন কবিতার মাতৃত্বে। আলোচ্য সঙ্কলনের ‘লাইব্রেরি আমার জীবন’ নিবন্ধে কবিতা বলেছেন ‘‘আমার মা... যাকে বলে বইয়ের পোকা... বলতেন লেখকের বই খাপছাড়া ভাবে পড়তে হয় না। মেথডিক্যালি পড়তে হয়। এভাবেই আমি তারাশঙ্কর... থেকে একেবারে আজকের এই মুহূর্তের লেখকদের লেখা পড়ে থাকি।’’ (পৃ ২০৫)। সেই পড়ার প্রমাণ আছে সঙ্কলনের ‘নবীন কলমে নবীন গল্প’ প্রবন্ধে, যেখানে তখনকার নতুন গল্পকারদের প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন কবিতা ১৯৭৭ সালে।

মায়েদের কথা, মেয়েদের কথা ফিরে ফিরে আসে কবিতা সিংহের লেখায়। সে-সব বিন্যাসকে নারীকেন্দ্রিক বিশেষণটিতে সাজাতে লেখকের কোনও বাড়তি সতর্কতা, অতিরিক্ত সচেতনতা বা আয়াসের বাড়াবাড়ি নেই। নারীস্বাধীনতার কথা সাতকাহন করে বলবার দরকার পড়ত না তাঁর। ‘আমার পুরুষ বন্ধুরা’র মতো লেখায় অথবা ‘অদ্ভুত পুরুষ ও রমণী’-র তৃতীয় অংশে দেবীশংকরের নিদারুণ পরিণতির বিন্যাসে তিনি অনায়াসে বুঝিয়ে দেন, যে, কলহে-সখ্যে-সঙ্কটে-সম্পদে কতখানি সটান জীবনচর্যাকে নারীত্বের উপমা ভাবতে তাঁর আগ্রহ। তাঁর লেখায় এ-চর্যার কোনও বিকল্প নেই। সেই সূত্রেই অন্দরবাসিনীদের শক্তির কথায়, সে-শক্তির মর্মান্তিক অপচয়ের কথায় পাঠককে বিদ্ধ করেন কবিতা। একই লেখার দ্বিতীয় অংশে বিন্যস্ত রেবতী মাসিমা বা রেবতীর পিসিমা স্বপ্ননলিনী, আবার চতুর্থ অংশে ঝিনিকের মতো বহির্যাত্রিণী এক অস্থির মেয়ে। সব কটি পরিণামেই যেন বিকল্পহীন দুর্দশা, সীমাহীন বঞ্চনা। অন্দর-বাহিরের এমন অনভিপ্রেতকে দেখতে আর দেখাতে নিজেকে কখনওই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানো দর্শকের ভূমিকা আরোপ করেন না কবিতা, ঠিক-ঠিক বিধানদাত্রীর দাবিও তাঁর নেই। ঘরে-বাইরের এমন অপচয়ে তাঁর নিজের কতখানি দায়, ঘরে-বাইরের সঞ্চয় থেকে কীই বা তাঁর জীবনের আর সৃজনের সংস্থান, সে-প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র লুকোছাপা নেই তাঁর। সে কারণেই কি রেবতী, স্বপ্ননলিনী, ঝিনিকের মতো খড়কুটো, আর ইন্দিরা গাঁধীর মতো প্রবল সাফল্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্বময়ী সমান গুরুত্বে বিন্যস্ত কবিতার লেখায়? ইন্দিরা-শতবর্ষের এক বছরেরও বেশি পরে ‘শিল্পী-সাহিত্যিকদের বন্ধু’ নতুন করে পড়তে পড়তে ভাবি ইন্দিরা তো একাধারে চূড়ান্ত জোরদার এবং একান্ত বিষণ্ণ এক উপন্যাসের বিষয়! কবিতা সিংহ কি কখনও অনুভব করেছিলেন তেমন কোনও উপন্যাসের মুহূর্ত?

Advertisement

কবিতা সিংহ-র অগ্রন্থিত গদ্য
সম্পাদক: সমরেন্দ্র দাস
৪৫০.০০
সহজপাঠ

শক্তি আর সমর্পণের এমন আশ্চর্য মিশেলে যে-গদ্যের চলন, তা কেমন করে এতখানি সরে গেল পাঠকের মন থেকে? একটু বেশি সাহসী আর সটান বলেই কি কবিতা সিংহের গদ্যকে গাঁথা গেল না পাঠকের অভ্যাসে? লেখকের অবশ্য এ নিয়ে অভিমানের বিলাস ছিল না কোনও। মৃত্যুর আট বছর আগে ‘কী লিখি, কেন লিখি’-তে লিখেছেন, ‘‘... এ পর্যন্ত দুশো গল্প লিখেছি। চল্লিশটি উপন্যাস। এতদ্‌সত্ত্বেও... ক’জনই বা আমাকে জানেন... আমার একটি দুটির বেশি লেখা পড়েছেন! ... নিজের দুর্ভাগ্যকে একেবারেই দোষ দিই না। নিজের বিফলতাকেই দায়ী করি।’’ (পৃ ৩০)। পঁয়ত্রিশটি বিচিত্র স্বাদের আর বিষয়ের গদ্য কবিতা সিংহের কত সৃজনের উপাদানে সমৃদ্ধ। ১৯৮৪-তে প্রকাশিত ‘অদ্ভুত পুরুষ ও রমণী’র প্রথমাংশে রাজা জয়ন্তকেশব আর রানি কালিকাসুন্দরীর আখ্যান তো সটান জুড়ে গিয়েছে মোমের তাজমহল উপন্যাসে। ‘অন্য জীবনের খোঁজে’র কোনারক দর্শন নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে ১৯৫৬-তে গ্রন্থিত একটি খারাপ মেয়ের গল্প উপন্যাসে। ‘আমার কলকাতা দর্শন’ পড়তে পড়তে পাঠকের স্মৃতিতে আসে এ-গদ্যের দু-বছর আগে লেখা ‘স্বামী নয়, প্রেমিকও নয়’ নামের অসামান্য ছোটগল্প, যেখানে বিজু তার পাড়ার মেয়ে (অফিসের সহকর্মীও) চারুকে বলছে, ‘‘... ভাবতে পারিস এই পার্ক স্ট্রিট কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?... তিলজলা বস্তিতে।’’ বিলাসবহুল চৌরঙ্গি থেকে নিউ মার্কেটের পিছনের অলিগলি দিয়ে তিলজলায় যাওয়া, আবার একই পথে পার্ক স্ট্রিটে ফেরার মনমাতানো বর্ণনা মেলে কলকাতা দর্শনের পরতে পরতে।

রসবোধ আর অনুভব-অন্তর্দৃষ্টির আশ্চর্য মিলমিশ দেখি কবিতা সিংহের গদ্যে। ‘ঈশ্বর কী’ নামের নাতিদীর্ঘ লেখায় বিশ্বাসকে কবিতা ভাবতে চান ঈশ্বরের সমার্থক। ‘পয়লা বৈশাখ এক পুনর্নবীকরণ’ নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছেন ‘‘আমাদের বৈশাখ মাসের শ্রেষ্ঠ লগনচাঁদা সন্তান’’ (পৃ ২১১), সকৌতুক সম্ভ্রমের বিশিষ্ট নিদর্শন বিছিয়েছেন ‘ব্যাজস্তুতি’ লেখাটিতে। রাজলক্ষ্মী দেবীর কবিতা প্রসঙ্গে ‘একক রাজলক্ষ্মী’ যেন নিজেই হয়ে উঠেছে কবিতা। ‘আমাদের ঘর চাই’ প্রবন্ধে দেশ-দেশান্তরের, আর্থ-সামাজিক স্তর-স্তরান্তরের, কাল-কালান্তরের কতশত নারীকণ্ঠকে তিনি গেঁথে ফেলেছেন বিনি সুতোয়। চিনা লেখিকা ডিং লিং-কে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখবার অধিকার কবিতা সিংহের থেকে বেশি কার? সে-লেখার যোগ্যতা তিনি জীবনভর অর্জন করেছেন; ‘দৈনিক কবিতা’ বা ‘কবিতার ঘর গেরস্তি’র মতো লেখা সেই অর্জনের দুরূহ পথকে খানিকটা জানান দেয়।

এতই জরুরি একটি কাজ করলেন আলোচ্য গদ্যগ্রন্থের সম্পাদক সমরেন্দ্র দাস, যে, তাঁর কাছে পাঠকের প্রত্যাশা বেড়েই চলে। ‘সূচনাকথা’য় উল্লেখ আছে বেশ কয়েকটি লেখার, যা নাকি সংগ্রহ করা যায়নি এই গ্রন্থপ্রকাশের প্রস্তুতিপর্বে। সে-তালিকায় সত্য গুহ সম্পাদিত ‘ঘরোয়া’ পত্রিকার ২৭ এপ্রিল ১৯৭৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘দীপেন’-এর কথা নেই। সে বছর জানুয়ারিতে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যুর পরে লেখা ওই নিবন্ধে স্মরণলেখের অছিলায় কবিতা ধরে দিয়েছিলেন নিজের প্রজন্মের যৌবনবেলা থেকে ব্যাপ্ত সময়কাল, সে-কালের সঙ্গতি-অসঙ্গতি, শীতলতা-উষ্ণতা, অস্বস্তি, উভটান। ‘অদ্ভুত পুরুষ ও রমণী’ নামের যে বিশেষ রচনা এই সঙ্কলনে রইল, সেটির প্রথম প্রকাশ ‘মহানগর’ পত্রিকায় (সেপ্টেম্বর ১৯৮৪)। অক্টোবর-নভেম্বর ’৮৪-র ‘মহানগর’ ছেপেছিল লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব যা এখানে অনুপস্থিত। দ্বিতীয় পর্বেরও চারটি ভাগ। প্রথম অংশ মনে করিয়ে দেয় মোমের তাজমহল-এ শিশিরকুমারীর কণ্ঠস্বর ‘‘... রাজবাড়ীতে বিয়ে হয়ে এসে জেনেছি... গল্পকাহিনীতেও যা ঘটে না বাস্তবে তা ঘটে।’’ দ্বিতীয় অংশ জুড়ে ১৯৬২-তে গ্রন্থিত (আলোচ্য সঙ্কলনের প্রচ্ছদে উল্লেখিত ১৯৬৮-তে নয়) সোনারুপোর কাঠি-র উপাদান। আর চতুর্থ অংশে বিন্যস্ত তেলের মাসি ঠিক যেন সদ্যগ্রন্থিত ‘অদ্ভুত পুরুষ ও রমণী’র চতুর্থাংশের ঝিনিকের মতোই এমনই ঘিরে রয়েছে কবিতার মন যে বিষাদের ভার থেকে সৃজনের নৈর্ব্যক্তিকতায় পৌঁছতে পারছেন না তিনি।

সকৌতুক আলাপে বলতেন কবিতা সিংহ, তাঁর অনেক লেখা হারিয়ে গিয়েছে। কী করে থাকবে গোছানো? তাঁর তো একটা বউ নেই যে গুছিয়ে রাখবে! যা গুছিয়ে তোলা গিয়েছে, তা কম নয়। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে বইটির সম্পূর্ণতর দ্বিতীয় সংস্করণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement