উত্তরবঙ্গের আদিবাসী
বিমলেন্দু মজুমদার
৪৫০.০০
গাঙচিল
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে প্রথম জনশুমারির কাজ করতে গিয়ে তৎকালীন জনশুমারি অধিকর্তা জে এ বাইন্স ১৮৯১ সালে আদিবাসীদের পৃথক ভাবে চিহ্নিত করে জনশুমারির কাজ শুরু করেন। বইটি থেকে জানা যায়, ঔপনিবেশিক শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দুঃসহ ঋণব্যবস্থা সহ্য করতে না পেরে ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগনার আদিবাসীরা নিজেদেরকে জমি থেকে উৎখাত করে, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কফি ও চা বাগিচায় চুক্তিশ্রমিক হিসাবে সপরিবারে যোগদান করেন। ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী আড়কাঠি দলের এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা ছিল। তাঁদের মধ্যস্থতায় উত্তরবঙ্গে দেশান্তরি হয়ে আসেন বিপুল সংখ্যক ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী। আবার, উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে আগে থেকেই বসবাস করে আসছিলেন নানা আদিবাসী গোষ্ঠী। বিমলেন্দু মজুমদার এই বইটিতে সুন্দর ভাবে তুলেছেন এই নানা আদিবাসী জীবন। বইটির শুরুতে বৈদিক ব্রিটিশ যুগে আদিবাসীদের অবস্থা, তাঁদের জীবনযাত্রার কথা আলোচনা করে তিনি এগিয়েছেন বিশদ বর্ণনার দিকে। ভূ-প্রাকৃতিক পার্থক্য অনুসারে উত্তরবঙ্গের আটটি জেলার ভৌগোলিক এলাকাকে তিনটি ভাগে করা হয়— দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার পার্বত্য অঞ্চল, হিমালয়ের পাদশৈল অঞ্চল এবং তাল, বরেন্দ্র ও দিয়ারা এলাকা নিয়ে গঠিত উত্তরের সমভূমি অংশ। এই তিন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবিকার ভিত্তিতে জীবনযাত্রার বিশদ আলোচনা বইটির বৈশিষ্ট্যও বটে, সম্পদও বটে।
বইয়ের শুরুতেই জমির সঙ্গে আদিবাসীদের যে মা ও শিশুর মতো সম্পর্ক, সে কথা বলা হয়েছে। বন-জঙ্গল, নদী-নালা এ সকলই আদিবাসীদের বিশ্বাসে ধরিত্রীমাতার দান। এই প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল তাঁদের জীবিকা নির্বাহ ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সেই বিশেষ ভৌগোলিক এলাকায় অবস্থিত জল, মাটি, বালি, পাথর, বনভূমি ইত্যাদি সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র বনভূমিকে ‘সংরক্ষিত বনভূমি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকার জমি থেকে উৎখাত হওয়া আদিবাসীদের শেষ সম্বলটুকু এ ভাবে কেড়ে নেয়। কী ভাবে দুঃসহ ঋণের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসীরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে শান্তির খোঁজে ব্রিটিশ সরকারের আর এক প্রতারণার শিকার হন, সে কথা বর্ণনা করা হয়েছে বইয়ের তৃতীয় ভাগে। বইটির চতুর্থ ও পঞ্চম ভাগে, ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনজাতি ও অন্যান্য কয়েকটি জনজাতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটির শেষ ভাগে এসে আলোচনা করা হয়েছে, কী ভাবে ব্রিটিশ বণিকদের জঙ্গলাকীর্ণ ও জনবিরল দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার অঞ্চলগুলিতে কৃষিনির্ভর চা শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ প্রথমে নেপাল ও পরবর্তী কালে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, খেরিয়া প্রভৃতি আদিবাসী পরিবারগুলিকে আড়কাঠির সাহায্যে এখানে নিয়ে এসে চুক্তিবদ্ধ বাগিচা শ্রমিকে পরিণত করে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এই জনজাতিগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক স্তরায়নের এবং রাজনৈতিক সংগঠন আদিবাসী মুক্তি মোর্চা পত্তনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এখানে। অনুশীলনসমৃদ্ধ গবেষণার ভিত্তিতে লেখা বইটি উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ইতিহাস সম্পর্কে পাঠককে সমৃদ্ধ করে।