জোনাকিদের বাড়ি
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
৫০০.০০
আনন্দ
কিছু কিছু ম্যাজিক পুরনো হয় না। প্রেম তেমনই এক ম্যাজিক, যা আজও পাঠককে সম্মোহিত করতে পারে। আর সেই প্রেমের গল্প যদি হয় স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর আদ্যন্ত শহুরে এবং সপ্রতিভ মুনশিয়ানায়, তা হলে কথাই নেই। কাহিনি শুরু হয় সোনাঝুরির কাজু ও পেখম নামে দু’জনের ছেলেমেয়ের প্রেমকাহিনির মধ্য দিয়ে। কয়েক দশক আগে একটি ক্যাথলিক ছেলের সঙ্গে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ের প্রেম। কিন্তু সেই নান্দীপাঠটুকু সেরেই কাহিনি চলে আসে সমসময়ে। সেখানে মাহিরের মতো ভাগ্যসন্ধানী যুবক, আইকার মতো স্বাবলম্বী নারী, নিশান, বাদল বা মেঘলার মতো অসহায় তরুণ-তরুণী, পুশকিনের মতো গম্ভীর মানুষ আর নোঈ-র মতো আশ্চর্য মেয়ে পালা করে কাহিনিসূত্র বোনে। আছে আরও অনেকে। প্লট-সাবপ্লটের নিখুঁত বিন্যাসে সকলে নানা প্রশ্ন বুনে এগিয়ে নিয়ে চলে কাহিনি। সচেতন লেখকমাত্রেই জানেন, একটি বৃহৎ কলেবর উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অবশ্যই দরকার পাঠকের মনে একের পর এক কোয়েস্ট বা কৌতূহল তৈরি করতে করতে যাওয়া। কখনও যেন কোনও জায়গা অনর্থক বা পুনরাবৃত্তি মনে না হয়। লেখক সফল ভাবে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পরতে পরতে নানা স্তর বুনতে বুনতে গল্প এগিয়ে চলেছে রিলে রেসের মতো, হাতে হাতে ব্যাটন বদলাবদলি করে। তার মধ্যেই তৈরি হয়েছে লেখকের সূক্ষ্ম সুতোর জালবিস্তার, যেখানে মিলে মিশে রয়েছে নানা রঙের সুতো। প্রথমে সবাইকে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও আস্তে আস্তে সকলের সঙ্গে সকলের যোগাযোগ স্পষ্ট হয়।
তবে এ ধরনের কাহিনিতে যেমন হয়, শেষ অবধি সব চরিত্রকে সমান গুরুত্ব দেওয়া যায় না, কাহিনির প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে কিছু চরিত্রের হঠাৎ পরিসমাপ্তি থাকে। এ কাহিনি তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু একেবারে দরকার নেই, এমন কোনও চরিত্রের কথা বলা যাবে না। সকলকেই মাপমতো পার্ট দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন লেখক। কোনও কোনও জায়গা আগে থেকে আন্দাজ করে নেওয়া সম্ভব হলেও তাতে পাঠ ব্যাহত হচ্ছে না। লেখকের পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। তিনি রিলিফের ব্যবহারও করেছেন যথাযথ। যেখানেই উপন্যাসের ঘটনাচক্র বেশ সিরিয়াস, সেখানেই তিনি অপেক্ষাকৃত হালকা কিংবা হিউমারাস সাবপ্লট এনেছেন। সেখানে পাঠক অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে এগোচ্ছেন। পাঠ কোথাও ভারাক্রান্ত হচ্ছে না।
এত বড় মাপের উপন্যাস প্রথমেই দাবি করে পাঠকের ধৈর্য। তার সঙ্গে লেখকেরও কিছু দায় থাকে। আজকের পাঠকদের হাতে বিনোদনের বিকল্প অনেক। গল্প বা উপন্যাস অল্প পড়ে পছন্দ না হলে সে তা সরিয়ে রেখে ডুবে যেতে পারে স্মার্টফোনে। কিন্তু লেখক পাঠককে অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগ দেননি। ঝরঝরে ভাষায় গল্প এগোয়। অবভিয়াস পেজটার্নার বা আনপুটডাউনেবল হয়ে ওঠার যে শর্ত বেস্টসেলারকে পালন করতে হয়, তার সব ক’টিই মানা হয়েছে। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হওয়ার কৃতিত্ব লেখকের অবশ্যপ্রাপ্য।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এই বেস্টসেলারকে সাহিত্য বলা নিয়ে। ‘সহিত’ অর্থাৎ সঙ্গে থেকে যাওয়ার দ্যোতনা সাহিত্য কথাটির মধ্যে থাকে। বিষয়বস্তু খুবই উপভোগ্য টানটান, বহু ধরনের উপাদানে পরিপুষ্ট। তবু গভীরতা বা ভাবনাচিন্তার উপাদান খুঁজতে গেলে হয়তো খামতি বোধ হবে। তবে এ বিতর্কের মীমাংসা এক কথায় অসম্ভব। সাহিত্যকে কালের কষ্টিপাথরে পরীক্ষা দিতে হয়— সে কালজয়ী হতে পারল কি না। এ বিচারের ভার সময়ের হাতেই থাক।