নারী দিবসের কাছাকাছি সময়ে বইটা হাতে এল। বইয়ের নাম কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি হলেও কঙ্কাবতীরাও যে আসলে কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন, এ বই তারই সাক্ষী। ভাল কাগজ ও ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে বিভিন্ন প্রজন্মের মোট আঠারো জন লেখকের লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পকে দু’মলাটের মধ্যে আনা হয়েছে। কাজটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। সম্পাদকের অনুসন্ধানের স্বীকৃতি দিয়ে বলতেই হয়, বাংলার মেয়েদের কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস যে এত প্রাচীন, বেগম রোকেয়া (জন্ম ১৮৮০) থেকে যার শুরু, এই বইটি না পড়লে তা জানা হত না।
গল্পগুলির ভালমন্দ বিচারের আগে ঠিক করে নিতে হয় কল্পবিজ্ঞান (সম্পাদক যদিও ‘কল্পবিজ্ঞান বা কল্পগল্প’ বলেছেন) নামক জঁরটি ঠিক কী চায়। যে গল্পের মূল ভাবনা বা প্লট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনও তত্ত্ব বা ধারণার উপর ভিত্তি করে থাকে, তাকেই কল্পবিজ্ঞান বলা যায়। অর্থাৎ, গল্পের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বাস্তবসম্মত না হলেও বিজ্ঞানের কোনও না কোনও ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে; এখানেই কল্পবিজ্ঞান শুধুমাত্র কল্পনানির্ভর আজগুবি ধারণা থেকে আলাদা। ‘কল্পবিজ্ঞান’ বলে প্রচলিত অনেক গল্প-উপন্যাসই এই নির্দেশরেখা মেনে চলে না। যেমন প্রফেসর শঙ্কু। গল্প হিসাবে দুর্দান্ত হলেও অ্যানাইহিলিন বা মিরাকিউরলকে কল্পবিজ্ঞান বলা যায় না, কেননা বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব দিয়ে তাদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়নি। এই নির্দেশ অনুসারে এই সঙ্কলনের আঠারোটি গল্পকে তিন ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। কিছু গল্প নিখুঁত কল্পবিজ্ঞান, কিছু গল্পের ক্ষেত্রে সাধারণ সামাজিক গল্পের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত কথাবার্তা আরোপ করে কল্পবিজ্ঞানের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, আর কিছু গল্প কোনও ভাবেই কল্পবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না।
কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি
সম্পা: অঙ্কিতা, যশোধরা রায়চৌধুরী ও দীপ ঘোষ৩৫০.০০
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
যেমন প্রথম ও প্রাচীনতম গল্পটি, অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানা’জ় ড্রিম’ পড়ে মুগ্ধ হতে হয়। এই গল্পে নানা রকম সৃষ্টিশীল এবং শান্তিকামী (নারীবাদীও বটে!) ধারণাকে তুলে ধরতে গিয়ে সরাসরি আলোর প্রতিফলন এবং লেন্সের সূত্রকে যথার্থ ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। এ ভাবেই ‘লুব্ধক-১৮’ (এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়), ‘যযাতীয় লালসাময়’ (সুকন্যা দত্ত), ‘ভিত্তি’ (অনুষ্টুপ শেঠ), ‘মেরিলিন’ (রিমি বি চট্টোপাধ্যায়), ‘নতুন মানুষ’ (তৃষ্ণা বসাক), ‘পালটা’ (অনুরাধা কুন্ডা) ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ (মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়) এবং ‘ঋক্থ’ (অঙ্কিতা), এই প্রতিটি গল্পেই কল্পনার সঙ্গে মিশেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা, প্রত্যেকটিই অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। উপগ্রহ উৎক্ষেপণের নিয়মকানুনের সঙ্গে কিছু কাল্পনিক ঘটনার মিল ঘটেছে ‘লুব্ধক-১৮’তে; বার্ধক্য রোধ করার নানা রকম শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতির বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়েছে ‘যযাতীর লালসাময়’-তে। তবে দু’টি গল্পই অতি দীর্ঘ। দ্বিতীয় গল্পটির অনুবাদ খুবই দুর্বল, এবং গল্পটিও হঠাৎ শেষ হয়ে গিয়েছে। সুকন্যা দত্ত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকর্মী ও লেখক, তাঁর আর একটু ছোট এবং সুলিখিত একটি গল্প থাকলে ভাল হত। এ ছাড়াও রোবট, সৃষ্টিতত্ত্ব, টাইম ট্রাভেল, গ্রহান্তরে মানুষ ইত্যাদি আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের নানাবিধ পরিচিত উপকরণগুলোও বিভিন্ন গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ‘ভিত্তি’ গল্পটি ঠিক বোঝা যায়নি, আর ‘মেরিলিন’ গল্পটিও শেষের দিকে খেই হারিয়ে ফেলে। বরং ‘পালটা’ এবং ‘নতুন মানুষ’ সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও যান্ত্রিক জীবনের সীমাবদ্ধতা বা অতৃপ্তির ছবি তুলে ধরে নিপুণ ভাবে। একটি পুরোপুরি পারিবারিক গল্পের শেষ পর্বে খুব অল্প বিস্তারের মধ্যে জিন ও ক্লোনিং সংক্রান্ত কিছু তথ্য ও একটি ধারণাকে আরোপ করে কল্পবিজ্ঞানের আওতায় আনা হয়েছে ‘কলাবতী’ (আইভি চট্টোপাধ্যায়) গল্পটি, ফলে সুখপাঠ্য গল্পটি কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। তবে সব দিক থেকেই অভিনব এবং চমৎকার ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’। বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স যে ভাবে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বকে পড়ে ফেলে, তাতে তার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তার একটা অসাধারণ চিত্র পাওয়া যায়। পরিমিত ও টানটান এই গল্পে খুব সূক্ষ্ম ভাবে মানবিক টানাপড়েনের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের উপকরণগুলিকে মেলানো হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি গল্প রয়েছে প্রফেসর শঙ্কু ধরনের, অর্থাৎ নানা রকম ‘আইডিয়া’ সমৃদ্ধ, যাদের কোনও ব্যাখ্যা নেই। কেউ বুদ্ধি বাড়ানোর ফর্মুলা দিয়েছেন (‘ফর্মুলা-১৬’: লীলা মজুমদার), কেউ মানুষের শরীরে একটি ছোট্ট যন্ত্র বসিয়ে তার সব রকম গতিবিধির হিসাব রাখার এবং যন্ত্রণা কমানোর কথা বলেছেন (‘যন্ত্রণানিরোধক যন্ত্র’: যশোধরা রায়চৌধুরী), কেউ টাইম ট্রাভেলের সাহায্যে জীবনে না-ঘটা ঘটনার কাছে পৌঁছেছেন (‘বাতাসে স্বপ্ন ভাসে’: পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়)। টাইম ট্রাভেল কল্পবিজ্ঞানের একটি পরিচিত বিষয়, কিন্তু তাকে ঠিক বিভিন্ন বায়ুস্তরের মধ্যে আনাগোনার সঙ্গে তুলনা করা বোধ হয় যথাযথ নয়। ‘শ্যাওলা’ গল্পে দেবলীনা মানুষের সালোকসংশ্লেষের ধারণা এনেছেন, আর ‘সমুদ্রের গুপ্তকথা’য় সংযুক্তা চট্টোপাধ্যায় সমুদ্রের নীচে গোপন নদীস্রোতের কথা বলছেন। কিন্তু এই ধারণাগুলোকে বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করার বদলে দুই গল্পের লেখকই কিছুটা আজগুবি এবং ভয়ানক ঘটনার অবতারণা করেছেন (দাঁতে আগুন জ্বলা দানব, সর্বগ্রাসী চ্যাটচেটে সবুজ তরল), যা কল্পবিজ্ঞানের শর্তবিরোধী তো বটেই, তার ফলে গল্পগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অমৃতা কোনারের ‘সময়চক্র’ গল্পটি সুখপাঠ্য, কিন্তু একে বড়জোর বিজ্ঞানীকে নিয়ে রহস্যগল্প বলা যায়। সম্পাদকের বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট যে, লেখকেরা অনেকেই কল্পবিজ্ঞান রচনায় অভ্যস্ত নন, তাঁদের লেখা থেকেও সেটা কিছুটা ধরা পড়ে।
বাণী বসুর ‘কাঁটাচুয়া’ একটি জনপ্রিয় গল্প, কিন্তু এই গল্পটিকে অলৌকিক, আধিভৌতিক যা-ই বলা যাক, কোনও ভাবেই কল্পবিজ্ঞান বলা যায় না। বন্দনা সিংহের লেখা তিনটি উপকথাও বিজ্ঞানাশ্রয়ী তো নয়ই, সুখপাঠ্যও নয়। বিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র অনুষঙ্গহীন এই গল্পগুলি কেন এই সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হল, বোঝা গেল না। ‘কোষ’ বানানটি বার বার কেন ‘কোশ’ ছাপা হয়েছে, সেটাও একটি প্রশ্ন হয়ে থাকল। মোটের উপর মহিলাদের লেখা কল্পবিজ্ঞানের লেখা সঙ্কলন করে সম্পাদকেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তবে গল্পসংগ্রহ আর একটু যথাযথ হলে আরও উপভোগ্য হত।