ষাটের শেষ ও সত্তর দশকের শুরুতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার শ্লোগান শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে রাজনৈতিক ইচ্ছে পূরণ হয়নি কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যের গতিমুখ বদলে যায়। এক ঝাঁক নতুন লেখক উঠে এসেছিলেন নানান জেলা থেকে। তাঁরা একা-একা আসেননি— গাঁ-গঞ্জের মানুষজন, গরু-ছাগল, নদীনালা, খরা-ঝরাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। লেখা ও লেখক দু’য়েরই গায়ে তখন ধানের গন্ধ, গো-খুরের ধুলো, নোনা বাতাসের ছাপ। চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি জেলা যেন চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছিল সে সব লেখায়। ওই সময়েই নলিনী বেরা এসেছিলেন ওড়িশা ঘেঁষা মেদিনীপুর জেলা থেকে।
পরের চার দশকে নলিনী গল্পের পাশাপাশি প্রায় প্রতি বছরই একটি করে উপন্যাস লিখেছেন। ‘ভাসান’ ‘শবরপুরাণ’ ‘অপৌরুষেয়’ ‘ঈশ্বর কবে আসবে’ ‘মাটির মৃদঙ্গ’-এর মতো উপন্যাস তাঁর স্বভূমি ও স্বজনদের জীবনচরিত। তাঁর চারপাশের জায়গাজমি ও চেনা মানুষজনকে তিনি এই সব উপন্যাসে তুলে এনেছেন। এ ধরনের লেখার জাত আলাদা, ধাতও আলাদা। দু’চার মাসের ক্ষেত্রসন্ধান ও মানুষজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে যে সব উপন্যাস লেখা হয়, তার থেকে নলিনীর লেখা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ লেখার শেকড় মাটির গভীরে, এ লেখার স্বর মানুষের ভেতরের। প্রতিটি পরিচ্ছেদেই মাটির কাছাকাছি একজন লেখকের আখ্যান হিসেবে এগুলি প্রতিষ্ঠা পায়।
নলিনীর সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা সে ধারারই রচনা। আঠাশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ উপন্যাসের কথক একজন কিশোর। শুরুতে সে শোনায় মানুষজন চায় তার মেজকাকার মতো সেও একজন নামজাদা কবরেজ হোক। মেজকাকা তাকে সাপের বিষঝাড়ার দু’চারটে মন্ত্র মুখস্থ করান এবং কিছু ওষধিও চেনান কিন্তু সাপের ভয়ে কিশোরটি হাল ছেড়ে দেয়। তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা নাচুয়া অনন্ত দত্ত চেয়েছিলেন তালিম দিয়ে ছেলেটিকে যাত্রাদলে চড়িয়া-চড়িয়ানি সাজাবেন, কিন্তু তাও হয় না মায়ের আপত্তিতে। মায়ের ইচ্ছে ছেলের লেখাপড়া আরও খানিক এগোক। তার পরে এ সব চিন্তা। সে কথা শুনে ধুতির খুঁটে বাঁধা পোকাধরা বেগুনগুলো কাঁধে ফেলে বিমর্ষ অনন্ত হাঁটা দেন। তার পরে পরেই আছে গাধার পিঠে বোঁচকা-বুঁচকি চাপিয়ে, শিকলে বাঁধা মেনি বাঁদরটাকে টানতে টানতে বাজিকরদের গাঁয়ে আসার কথা। এ তিনটি ঘটনাতে কিশোর কথকের পরিবার এবং গ্রামটিকে বেশ খানিক চেনা হয়ে যায় পাঠকের।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কিশোরটির স্কুলযাত্রার ভেতর দিয়ে কাহিনি আরও বিস্তার পায়। গ্রামের উত্তরে সুবর্ণরেখা নদী। তার পর বেশ কিছুটা পথ পেরোলে ডুলুং নদী। তারও খানিক পরে কিশোরটির রোহিণী চৌধুরানি রুক্মিণী দেবী হাই স্কুল। স্কুল ছুঁয়ে কাহিনি এগিয়ে যায় সুবর্ণরেখার তীরে। অজস্র ভিনদেশি গাছ সেখানে। কথিত আছে এই ‘জাহাজকানার জঙ্গলে’ দূর অতীতে একটা মালমশলা ভরা জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। তখন জাহাজ ডোবার জল ছিল সুবর্ণরেখায়। এখন সে গভীরতা নেই কিন্তু জলের উৎসব আছে। হংসী নাউড়ীয়ার নৌকাটিকে ফুল-চন্দনে সাজিয়ে পাঁচ গাঁয়ের মানুষ নৌকাবিলাসে বেরোন। তাঁঁদের কপালে তিলক, গলায় কাঠমালা, গায়ে ‘লাউফুলের মতো সাদা গেঞ্জি’। জলের উপর পড়া সূর্যকিরণের খানিক লাল প্রতিফলন তাঁঁদের গায়েও। কিশোর ললিনকেও তাঁঁরা সঙ্গে নেন কারণ নাউড়ীয়ায় সঙ্গে নৌকাবিহারে তার মহা উৎসাহ। স্কুলে পড়া বিদ্যা আর ‘মাছের কাঁটার মতো হাতের লেখা’-র গুণে সে মানুষজনের বড়ো সহায়। নলিনী বাস্তবের নদীর সঙ্গে মিথ, পুরাণ, প্রকৃতি, উৎসব এবং খানিক নিজের কৈশোরকে জড়িয়ে নিয়ে প্রথম পরিচ্ছেদেই উপন্যাসের স্বরটি বেঁধে নেন।
সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা
নলিনী বেরা
৩০০.০০, দে’জ পাবলিশিং
এ উপন্যাসের ভৌগোলিক অবস্থানটি অদ্ভুত। এখানে নদী তীরে বছরের শেষ দিনে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার মানুষেরা বালিজাত্ উৎসব পালন করেন। মহাভারতের কালে অজ্ঞাতবাস পর্বে এখানে বারিতর্পণ করেছিলেন যুধিষ্ঠির। এ উৎসব তারই স্মৃতিতে। সে স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে থাকে বাংলা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার বর্তমানও। মানচিত্রের নতুন রেখায় এ অঞ্চল ওড়িশাতে ঢুকে পড়ে আবার বেরিয়েও আসে। কিন্তু জীবন তো মানচিত্রকে ছাপিয়ে যায়। তাই কথকের জামাইবাবু আসেন ওড়িশা থেকে, বিহার মুলুক থেকে ছেলের নাচনি বউ মেলে আর ললিনের কৈশোরের কাম ও কামনা জড়িত রসনাবালা ভিন রাজ্যে চলে যায়। সেই সঙ্গে নানান মিশ্রণে ভাষাও নতুন রূপ নেয়। হাটুয়া ভাষা তৈরি হয়। উঠোনে বসে ছোটরা পড়ে— দেয়ার ইজ এ ফ্রগো, সেঠিরে গুট্যে ব্যাঙো।
যে বিস্তৃত জনপদকে ঘিরে এ উপন্যাস, তার জনবিন্যাসটিও বেশ আকর্ষণীয়। চার বর্ণের মানুষই রয়েছেন এই অঞ্চলে এবং সে সঙ্গে আদিবাসী মানুষজনও। শ্রীচৈতন্য এ পথ ধরে নীলাচলে যাওয়ার সময় শুনিয়েছিলেন যে হরিনামে চণ্ডালও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হতে পারেন। তার পরে বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক প্রভাব পড়ে এই অঞ্চলে। সে সঙ্গে বাইরে থেকে কিছু গোস্বামী ও ব্রাহ্মণ এসে হাজির হন। তাঁঁরা রাতারাতি সামন্ত রাজাদের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বানিয়ে দেন এবং প্রচুর ভূসম্পত্তি লাভ করেন। সে ধারা ললিনের কালেও প্রচলিত। হস্টেলের রাঁঁধুনি টুনিঠাকুর রাখীপূর্ণিমার দিন টুডু হেমব্রম হাঁসদা মাহাতো সিং পৈড়াদের বেশ চড়া দামে পৈতে বিক্রি করেন। এক সময় ব্রাহ্মণ-গোস্বামীরা ভূস্বামীদের নতুন বংশলতিকা বানিয়ে দিয়েছিলেন। তেমনই নতুন এক বংশলতিকা বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন টুনিঠাকুর চাল চুরির ঘটনাটি গোপন রাখার শর্তে। আদিবাসীরাও বদলে যেতে থাকেন অর্থনৈতিক নানা কারণে। বৃদ্ধ সাঁওতাল শোনান এক কালে মাথার উপর হাত তুলে মেঘপাতাল ছোঁয়ার কথা কিন্তু এখন সে আকাশ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সাঁওতালদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতে ‘সিঞ চাঁদো’-ও আর মাটিতে নেমে আসেন না। ললিনের নাইন পাশ করা কাকা বিজয়চন্দ্র যান মঙ্গল সরেন, ত্রিলোচন হাঁসদা, বুধন মুর্মুর কাছে কী করে পুলিশ-মিলিটারিতে ঢোকা যায় তার পরামর্শ নিতে। নলিনী এই জরুরি অর্থনৈতিক বিষয়টিকে নিজস্ব বোধেই উপন্যাসে জুড়ে রেখেছেন।
সুদূরবিস্তারী সুবর্ণরেখা ও ক্ষীণতোয়া ডুলুং নদী, অরণ্য, জঙ্গলমহাল ও কৃষিভূমি ইত্যাদি মিলে যে বিস্তৃত ক্ষেত্র সেখানে বর্গি ও মোগল হানা দিয়েছে। নীল চাষের পর্বে অত্যাচার চালিয়েছে সাহেবরাও। নতুন চর জাগলে তার দখল নিয়েও মারামারি, খুনজখম, থানাপুলিশ, কোর্টকাছারি। তা থেকে তৈরি হয় প্রবাদ, লেখা হয় গান। যেমন বৈশাখীর চর নিয়ে চালু হয়— বিধি লেখি আছে কপালে/ বৈশাখী পালে গো বৈশাখী পালে। এমন সব রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপড়েনের ভেতর মনোরোগী পিসির সন্ধানে দু’ভাইপো দূর পথ পাড়ি দেয়, হংসী নাউড়ীয়ার বোনের শুকনো চোখে জলের ধারা নামে, ছাগল-চরানি সরলা সেজেগুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসে।
নলিনী বেরা আশৈশব তাঁর আপন ভূখণ্ডটিকে দেখেছেন। একই সঙ্গে পড়েছেন ওই অঞ্চলের ইতিহাস এবং পুরাণ। কথাগদ্যের হাতটিও তাঁর বেশ ভাল। সব মিলে সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা বাংলা কথাসাহিত্যে একটি সোনার আঁচড়।