কলকাতার বাঙাল/ উভচর স্মৃতি
অরুণ সেন
৪৫০.০০, রাবণ
‘‘ছোটবেলা থেকেই টের পেয়েছি, আমাদের বাড়িতে কোনোরকম সামাজিক বিভেদের চিহ্নমাত্র ছিল না।’’— মন্তব্যটি ১৯৩৬-এ জন্মানো এমন এক বাঙালির, যাঁর পা পোঁতা আছে তাঁর স্বদেশ বাংলার দুই চরে। অরুণ সেন সেই উভচর বাঙালি যাঁর পূর্বপুরুষের দেশ বলতে পূর্ববঙ্গ, যিনি তাঁর এই আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন ‘‘বাড়িতে ছোটোবেলায় ঠাকুমা বা বাবা-মার গলায় দীর্ঘকাল বাঙাল ভাষাতেই কথাবার্তা শুনতাম।’’ সঙ্গে এও জানাতে ভোলেননি, ‘‘ব্যক্তিগত পরিচয়ে আপাদমস্তক আমি কলকাত্তাই।’’
বিশ শতকের কুড়ির দশকের গোড়ায় অরুণবাবুর ঠাকুরদা ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসেন, তাঁর মৃত্যুর পর অরুণবাবুর বাবা সপরিবার মধ্য-কলকাতায় এসে বাসা বদল করতে করতে উঠে এসেছিলেন যে সরু আঁকাবাঁকা বৃন্দাবন মল্লিক লেনে, ‘আমার শৈশবের সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি তাকে ঘিরেই...’ খেই ধরিয়ে দিয়েছেন লেখক। তার পর ফিরে গিয়েছেন শৈশবস্মৃতিতে: ‘‘হিন্দু বা মুসলমানদের প্রতি ব্যবহারেও কোনো ফারাক দেখিনি পরিবারে। আমার ঠাকুমা ও মা নিজের হাতে মুসলমানদের ছুঁয়েই জলের গ্লাস এগিয়ে দিতেন, এবং নিজের হাতেই সেটা ধুয়ে বাসনপত্রের ঢাঁইয়ের মধ্যে রাখতেন। কেউ ‘জাত’ কী জিজ্ঞাসা করলে, সেসময়ে সেটা খুব চালু ছিল— ঠাকুমা আমাদের বলতে শিখিয়েছিলেন, আমরা জাত মানি না।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
লিখেছেন টিফিনে স্কুল পালিয়ে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া দেখার প্রথম স্মৃতি। শতক-পেরোনো এই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক ভ্রমণের আদল নিয়েছে তাঁর স্মৃতি। তাতে ঢেউয়ের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, কমিউনিস্ট পার্টি, নকশাল আন্দোলন, ভারত-পাক যুদ্ধ, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ, জরুরি অবস্থা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বা এ রকম আরও কত কিছুর ওঠাপড়া, একেবারে এই দশকের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। অভিজ্ঞতার পট-পরিবর্তনে মুক্তির নতুন নতুন দিশা আর দীপ্র মনের মানুষজনের উপস্থিতি আগাগোড়া জীবন্ত করে রাখে তাঁর স্মৃতিকথনটিকে। তবুও সংশয় থেকেই যায় তাঁর: ‘‘চারদিকের এই অপচয় বা ভাঙন বা ধ্বংসের মধ্যে আমার এই বন্ধুদের বা এই ধ্যানী মানুষদের উপস্থিতি আমাদের সাম্প্রতিকতায় শেষপর্যন্ত কতটুকুই বা উদ্ধার?’’ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির রাস্তা ধরে নিত্য আসাযাওয়া এই স্মৃতির আখ্যানখানির, যা অবিরত অনুসন্ধান করে চলে স্বদেশের প্রকৃত সত্তা আর তার জটিল বিন্যাসকে।