book review

Book Review: রুপোলি বেষ্টনী পেরিয়ে

কবি, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, নাট্যব্যক্তিত্ব, সমালোচক, সাংবাদিক, প্রকাশক— বিভিন্ন বৃত্তের গুণিজনের রচনায় ঋদ্ধ এই সঙ্কলনটি।

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:৩৫
Share:

ষাটের দশকের গোড়ার কথা। শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এক জায়গায় চলেছেন, আর তাঁদের গাড়িতে চাপিয়ে চালিয়ে নিয়ে চলেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অথচ “সত্যজিতের নামের সঙ্গে প্রায় অচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে তাঁর নাম, কাজেই আমাদের চোখে তাঁর জৌলুসই তখন আলাদা।” লিখছেন শঙ্খ ঘোষ। ২০২০-র নভেম্বরে সৌমিত্র-প্রয়াণের পর গত ফেব্রুয়ারিতে সৌমিত্র মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: দেখি বিস্ময়ে, আর তাতেই আছে শঙ্খ ঘোষের এই গদ্য।

Advertisement

কবি, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, নাট্যব্যক্তিত্ব, সমালোচক, সাংবাদিক, প্রকাশক— বিভিন্ন বৃত্তের গুণিজনের রচনায় ঋদ্ধ এই সঙ্কলনটি। প্রত্যেকেই নিজস্ব ভঙ্গিতে ফিরে দেখেছেন সৌমিত্রের ভিতরের শিল্পী মানুষটিকে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু ও জয় গোস্বামী। অভিনেতা, কবি, নাট্যকার, নির্দেশক, বাচিক শিল্পী, সম্পাদক, গদ্যকার, এমনকি ছবি-আঁকিয়ে হিসাবেও কত অনন্য ছিলেন সৌমিত্র, সে পরিচয়ই পাওয়া যাবে এঁদের লেখায়। তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তির কথা বলেছেন দীর্ঘ কালের কর্মসঙ্গীরাও— শর্মিলা ঠাকুর, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, কুশল চক্রবর্তী, দীপঙ্কর দে। আছে তাঁকে নিয়ে মা-পুত্র-কন্যার রচনাও।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: দেখি বিস্ময়ে
সম্পা: সৌমিত্র মিত্র
৪৯৯.০০
পূর্ব পশ্চিম, দে’জ পাবলিশিং

Advertisement

শঙ্খ ঘোষের রচনাটি তবু আলাদা স্বাদের। গল্পচ্ছলে তিনি সৌমিত্রের অভিনয়-অভিপ্রায় সম্পর্কে গভীর কোনও এক সত্যে পৌঁছতে চান। সৌমিত্র বিষয়ে তাঁর মত এই যে, ‘ম্যাটিনি আইডল’ বা দূরবর্তী তারকার মূর্তি হয়েও “সাধারণের কাছে অনধিগম্য সেই রুপালি মূর্তিতে পৌঁছতে চানইনি তিনি কখনও... এখানে এক সচেতন অভিপ্রায়ই কাজ করে গেছে সৌমিত্রর মনে।” খেয়াল করিয়ে দেন তিনি “কাজটা শক্ত ছিল।” শক্ত তো বটেই। সাধারণত ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা নিজেদের চার পাশে আরোপিত এক মহিমার বেষ্টনী তৈরি করে ফেলেন রুপোলি পর্দার দৌলতে। পরিমণ্ডলের চাপে বাঁধা পড়ে যান, বেরিয়ে আসতে পারেন না সহজে, চলতে পারেন না নিজের শর্তে। শিল্পী যে নিছক কল্পজগতের বাসিন্দা নন, শিল্প যে আমাদের দৈনন্দিনতার সঙ্গে জড়ানো, সে চেতনাই প্রকাশ করতে চাইতেন সৌমিত্র তাঁর স্বাভাবিক চালচলনে।

আত্মপরিচয়: আমার ভাবনা। আমার স্মৃতি
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
৩৯৫.০০
পত্রভারতী

সেই চালচলনের পরিচয়ই পাবেন পাঠক পত্রভারতী-প্রকাশিত সৌমিত্রেরই একটি গদ্যগ্রন্থে, তাঁর মৃত্যুর ক’দিন আগেই বেরিয়েছিল: আত্মপরিচয়। তাতে সত্যজিতের অশনি সংকেত-এ নিজের অভিনয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা আছে তাঁর। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর: ছবির বিষয়। সত্তর দশকের গোড়ায় যখন ছবিটা করার প্রস্তুতি চলছে, তখন নকশাল আন্দোলন যুববিদ্রোহ তাড়িয়ে ফিরছে সৌমিত্রকে। খুবই বিচলিত থাকতেন ভারতের গ্রাম নিয়ে— মনে হত তাঁর, আজও যেন সেই পরাধীন ভারতের গ্রাম। শহর এবং গ্রাম আলাদা দুটো দেশ— এক ভাষায় কথা বলি বটে, কিন্তু একই জীবন আমরা যাপন করি না। নিজেকে প্রশ্ন করছেন: “আমি একজন ইউরোপীয় বন্ধুকে যতটা চিনি, একজন গ্রামের মানুষকে কি ততটা চিনি? রমা কৈবর্ত, হাসিম শেখকে আদৌ চিনি তো?” এই মানসিক পীড়ন বা যন্ত্রণা থেকেই তিনি অভিনয় করতে ঢুকেছিলেন অশনি সংকেত-এ।

এ বইয়েরই আর একটি গদ্যে লিখছেন: “মন্বন্তরের সময়কার কিছু বীভৎস স্মৃতি আমার জীবনে আছে।... তখন আমার বয়স খুবই কম। তেমন কচি মন বলেই হয়তো ছাপটা অত গভীর হয়ে পড়েছিল। ক্ষুধা যে সর্বগ্রাসী হতে পারে, মানুষের সত্তাকে কীভাবে গ্রাস করতে পারে, এক একটি কঙ্কালসার চেহারায় তার ছাপ ছিল স্পষ্ট।... অনেক পরে ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করার সময় আমি সেই স্মৃতির কাছে ফিরে গিয়েছিলাম।”

নিজের ভাবনাচিন্তা, পরিবেশ, প্রতিবেশী মানুষের প্রতি দৃষ্টিপাত— এ সব খানিকটা জার্নালের মতো করে লিখেছিলেন সৌমিত্র এক দৈনিকে, সে সবেরই সঙ্কলন বইটি।

দেখি বিস্ময়ে-তে ফিরে আসি। অশনি সংকেত ছবিতে সত্যজিতের সহযোগী হিসাবে কাজ করার সুবাদে সন্দীপ রায় খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছেন অভিনয়ের জন্য সৌমিত্রের প্রস্তুতি। একটা ডায়েরি রাখতেন সৌমিত্র, যাতে চিত্রনাট্যের খুঁটিনাটি লেখা থাকত— “আমি জানতে চাইলে বলতেন, খুঁটিনাটি নোটস রাখছি যাতে ক্যারেক্টার-এর ইন্টারপ্রিটেশন ঠিকঠাক করতে পারি।... এটাই আসলে একজন টেকনিক্যাল অ্যাক্টর-এর যথার্থ পরিচয়। সৌমিত্রকাকু একজন যথার্থ টেকনিক্যাল অ্যাক্টর এবং ‘অ্যাক্টর অব দ্য ডিরেক্টর’ বলা যায়।”

একুশ শতকের গোড়ায় গৌতম ঘোষের দেখা-য় ক্রমশ দৃষ্টিহীন হয়ে আসা একটি চরিত্রের জন্য একই ভাবে হোমওয়ার্ক করেছিলেন সৌমিত্র, দৃষ্টিহীনতার ফলে অন্য স্নায়ুগুলো অনেক প্রখর হয়ে যায়, এগুলো নিয়ে ব্লাইন্ড স্কুলে গিয়ে স্টাডি করেছিলেন, যার ফলে ওঁর ওই নিখুঁত অভিনয়। গৌতম লিখছেন, “সিনেমাটা দেখে এক ভদ্রমহিলা একটা চিঠি পাঠান সৌমিত্রদাকে। তাঁর স্বামীর ওইরকম গ্লুকোমাতে দৃষ্টি চলে যায়... মহিলা লিখছেন যে এই চরিত্রে সামগ্রিকভাবে আপনি যা করেছেন, আমি তো আমার স্বামীকে দেখছি, সেই দৃষ্টি থেকেই বলছি একদম নিখুঁত করেছেন। সৌমিত্রদা চিঠিটা পড়ে বললেন, দেখো এর থেকে বড় পুরস্কার আর কিছুই হতে পারে না যে একটা চরিত্রকে আমি বিশ্বাসযোগ্য করতে পেরেছি।”

চরিত্রকে বিশ্বাস্য করে তোলাই একমাত্র অভিপ্রায় হওয়া উচিত অভিনেতার, অথচ উল্টোটাই ঘটে প্রায়শ। আমরা আর চরিত্রটিকে দেখি না, দেখি অভিনেতাকে, কিংবা সেই ম্যাটিনি আইডলকে, দেখি নক্ষত্রকে। অথচ নক্ষত্র হয়েও ঠিক এর বিপ্রতীপ চলনটিই ছিল সৌমিত্রের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement